ফটকে বড়ো বড়ো দু’টি তালা ঝুলিয়ে দেশের রাষ্ট্রনায়ককে বোঝানো হলো পুত্রহারা মা’কে সমবেদনা জানাতে যাওয়াও ‘অপরাধ’! দেশের এমন বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যখন দেশের হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিটে শত শত দগ্ধ মানুষ জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। তাদের শারীরিক যন্ত্রণা ও জীবন বাঁচানোর তীব্র আর্তনাদে হতাশ, ক্ষুব্ধ দেশের জনগণ যখন এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে- তখনই এমন বিরল একটি সুযোগ নস্যাৎ করে দিলেন বিএনপি’র নীতিনির্ধারকরা।১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ পরিবারের সকলকে হারানো, ২১ আগস্ট নিজের উপর গ্রেনেড হামলা-সব ভুলে বঙ্গবন্ধু তনয়ার আকুল মাতৃত্ব জেগে উঠেছিলো সন্তানহারা এক মায়ের পাশে গিয়ে সমবেদনা জানানোর জন্যে। তাই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র কোকোর মুত্যুতে সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার মাধ্যমে দু’জনের সাক্ষাত জন্ম দিতে পারতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের চরম কাঙ্খিত একটি ক্ষণের। যে ক্ষণটিতে রাজনৈতিক বৈরিতার উর্দ্ধে প্রতিষ্ঠিত হতো মানবিক সম্পর্ক। কিন্তু না,এ বৈরিতা যারা বজিয়ে রাখতে চান-তাদের শক্তির জয় হলো।
খালেদা জিয়া নিজের কৃতকর্ম বা দায়িত্বশীলতা কোনটিই কখনো বিবেচনা করেন নি। তাই তাঁর নেতাসুলভ উদারতা দেখানোর অসাধারণ একটি সুযোগ সচেতনভাবে হারালেন।
ধিক্কারের ভাষাও হারিয়ে যায়!এমন আচরণ করলেন খালেদা-যা ভুলিয়ে দেয়,একসময়ে তিনি এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর পরও কি তিনি আশা করেন এ দেশের আপামর জনতা তাকে ভোট দেবেন?
পুত্রশোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার রাতে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে গেলে ফটক বন্ধ রাখা হয়। বারবার প্রমাণ হয়েছে, মানুষকে ভালোবাসা উজাড় করে দেবার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কন্যার মানবিক অনুভূতি বরাবরই অনেকের চেয়ে অনেক বেশি। বিএনপি নেত্রীর প্রধান ফটকের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর গাড়ি থেকে নামেন রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে। পায়ে হেঁটে প্রধান ফটকে গিয়ে তিনি দেখতে পান তাতে বড় বড় দুটি তালা লাগানো। ফটকের সামনে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হবার আগে সেখানে যান আওয়ামী লীগের দুই প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ। ফটকে তালা দেখে প্রধান ফটক খুলে দেয়ার জন্য ভেতরে থাকা নেতাদের অনুরোধ জানান তাঁরা।
কিন্তু তালা খুলে দেয়া হলো না। বিএনপির কোন সিনিয়র নেতা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের সাথে সৌজন্য দেখাতেও বেরিয়ে এলেন না। এর পর খোদ প্রধানমন্ত্রী হাজির হলেন, তবু তারা কেউ বেরিয়ে এসে সামান্য সৌজন্যতা ও দেখান নি। বরং দলীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকে জানানো হয়- “পুত্রশোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এই মুহূর্তে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।”
প্রায় সাত মিনিট প্রধান ফটকের সামনে খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষা করেও সাক্ষাত না পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত বিএনপির গুলশানের কার্যালয় থেকে গণভবনে ফেরত আসতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পর ইসলামী ঐক্যজোট এবং জামায়াত নেতারা গেছেন-তাদের জন্যে ফটকের তালা খুলে দেয়া হলো।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে,কোকোর মৃত্যুর খবর প্রচারিত হবার পর শনিবার দুপুর থেকেই খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তাঁর কার্যালয়ে যান। তাঁদের মধ্যে অনেকের সাথেই কথা বলেছেন খালেদা জিয়া।
তবে বিকেলে যখন জানানো হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে গুলশানের কার্যালয়ে আসবেন,এর পরই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান, খালেদা তারেকের আইনজীবী মাসুদ তালুকদারসহ অন্য নেতারা বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে কথাও বলেন।
খালেদা সিদ্ধান্ত দেন তিনি দেখা তো করবেন ই না, ফটকে বড়ো বড়ো দু’টি তালা ঝুলিয়ে দেবেন। চমৎকার সিদ্ধান্ত। দেখা না করার অনেক উপায় আছে। যিনি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে সাংবাদিকদের ডেকে তাঁর প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলেই উঠে চলে যান-তিনি কারো সাথে সৌজন্য দেখাবেন -সেটা অনেকটা অবাস্তব। তবে বাস্তবতা হলো,তিনি মানুষকে অপমান করার চুড়ান্ত মাত্রাটি খুব ভালোভাবে দেখাতে চান অন্যদের। তাঁকে নতুন করে জন্ম দেয়া তাঁর ধর্মপিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কালো দিন ১৫ আগস্টে ঘটা করে কেক কেটে জন্মদিন পালন করে ঘাতকদের ষড়যন্ত্রে নিহত পিতাকে প্রতি ক্ষণে চুড়ান্ত অপমান করেন যিনি, তাঁর কাছে সৌজন্যতা আশা করা যে কতো বড়ো ভুল- তা আবারো প্রমাণ হলো। আর অপমানের লক্ষ্য যদি হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা -তাহলে অপমানের সর্বনিম্ন স্তরে নামতেও সদা প্রস্তুত খালেদা জিয়া-সেটাই চাক্ষুস করলো জনগণ।
শনিবার সন্ধ্যা ৭টার পরপরই খালেদা জিয়া দলীয় কার্যালয়ের যে রুমে অবস্থান করছিলেন, সেটার দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রীর গুলশানের কার্যালয়ে আসার আগেই বিএনপি হাইকমান্ডের নির্দেশে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীরা প্রধান ফটকে দু’টি বড় বড় তালা ঝুলিয়ে দেয়।
দীর্ঘসময় ধরে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিএনপির কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, তখনও ওই কার্যালয়ের ভেতরে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
গণভবন সূত্র জানায়, সাক্ষাত না পেয়ে গুলশান থেকে সরাসরি নিজের সরকারি বাসভবন গণভবনে ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ফিরেই তাঁর সঙ্গে থাকা নেতাদের সঙ্গে অনির্ধারিত বৈঠকও করেন তিনি।
জানা গেছে, পূর্ব থেকে জানানো সত্ত্বেও ফটকে তালা ঝুলিয়ে ফিরিয়ে দেয়ায় বিস্মিত, বেদনাহত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি উপস্থিত রাজনৈতিক নেতাদের বলেন, “স্বজন হারানোর বেদনা আমার চেয়ে কে বেশি অনুভব করে? আমি একরাতে বাবা-মা, ভাইসহ সবাইকে হারিয়েছি। আমি তো একজন মা হিসেবে আরেক পুত্রহারা মা’কে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম। সেটাও করতে দেয়া হলো না!”এরপর আর কারো সাথে কোন কথা বলেননি প্রধানমন্ত্রী।
২০০৯ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁদের ধানমন্ডির বাসভবন সুধাসদনে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমবেদনা জানান এবং দুই নেত্রীর মধ্যে কিছুক্ষণ কথাও হয়। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুই নেত্রী একসাথে উপস্থিত থাকলেও তাঁরা কথা বলেননি। সর্বশেষ ২০১৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর শোক জানাতে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। সেদিনও খালেদা -হাসিনার মধ্যে কথা হয়নি।
বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ মোস্তফা ফিরোজ আরেকটি বেসরকারী চ্যানেলের টক শো তে এ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে না পেরে ফিরে আসার পর ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াত নেতারা দেখা করেন বেগম জিয়ার সাথে। বেগম খালেদা জিয়া কাদের পরামর্শ নিচ্ছেন, যারা দেশের কোটি কোটি মানুষের অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান একটি মুহূর্তকে এভাবে নষ্ট করে দিলেন?” তিনি প্রশ্ন করেন, “কী এমন ক্ষতি হতো-যদি দু’জনের সাক্ষাত হতো? বরং এ সাক্ষাত হয়তো দেশের চলমান সংকটের নিরসন ঘটাতে পারতো।”
অনেকে ভুলে গেছেন, ২৬ অক্টোবর ২০১৩ সন্ধ্যে সোয়া ছয়টারদিকে খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে ৪০ মিনিট নিস্ফল আলাপ করেন প্রধানমন্ত্রী । দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক সংকটের চরম পরিস্থিতি সমাধানে সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে সংলাপে মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের প্রস্তাব দিতে গিয়ে অপমানিত হয়েছিলেন।
সেসময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে টানটান উত্তেজনার মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে গণভবনে নৈশভোজের দাওয়াত দেন। হরতাল প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদল নেতা খালেদা জিয়া। খালেদার বেঁধে দেওয়া দু’দিনের সময়সীমার মধ্যে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হরতাল, জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছিলেন । সেই টেলি সংলাপ প্রকাশ হবার পর দু’জনের রুচি এবং মানবিক অবস্থানের চরম বৈপরীত্য উন্মোচিত হয়ে যায় জনগণের কাছে। কতোটা অভদ্র জনোচিত ছিল সেই টেলি সংলাপ -সেটা ফিরে দেখলেই হয়। খালেদা। একই ভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চরম অপমান করে ‘পরবর্তীতে যে কোন সময়ে আলোচনা’ র নাটকীয় বক্তব্য দিলেন এবারেও।
রাত আটটার দিকে গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শিমুল বিশ্বাস হঠাৎ করেই সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে বলেন, পুত্র হারানোর শোকে কাতর খালেদা জিয়াকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।তিনি (খালেদা জিয়া) সুস্থ হলে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের বিষয়টি জানানো হবে।তবে সকলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চলমান অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক মন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলসহ অন্যান্য নেতারা ছিলেন। কিন্তু প্রধান ফটকে প্রায় সাত মিনিট অপেক্ষা করার পরও সাক্ষাত না পেয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরে আসতে হয়। প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার কিছু সময় পর গুলশানের কার্যালয় থেকে একে একে বেরিয়ে যান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ দলটির সিনিয়র নেতারা। এই সিনিয়র নেতারা কি উদ্যোগ নেন নি? নাকি তারাও চান না দুই নেত্রীর দেখা হোক?
রাত সাড়ে নয়টার দিকে আবার প্রেস ব্রিফিং করে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, ‘শোকের ঘটনা নিয়ে কেউ যাতে নোংরা রাজনীতি না করেন।’
তিনি বলেন, “আমি শোকবই নিয়ে আসতে না আসতেই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চলে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী এক মিনিটের মধ্যেই গেট থেকে ফিরে গেছেন। কেউ তাঁর (খালেদা জিয়া) পুত্রশোক নিয়ে কুৎসিত রাজনীতি করুক, আমরা তা পছন্দ করি না। দেশের রাজনীতিতে শালীনতা ও সৌজন্যতা সবাইকে রক্ষা করতে হবে। এ নিয়ে রাজনীতি করে কেউ যেন চলমান সমস্যার সমাধানের পথে কোন বাধার সৃষ্টি না করে।”
শিমুল বিশ্বাস জানেন, গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারে এদেশে বেশ ভালোই রাজনীতি করা যায়। শোকবই এনেছেন, দেখাচ্ছেন টিভি ক্যামেরাকে- তাতে একটি স্বাক্ষরও নেই। হঠাৎ একটা খাতা এনে লিখে দিলেন শোক বই- তাতেই হয়ে গেলো? প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের জন্যে শোক বই যদি রাখবেন, আগে থেকে একটি টেবিল চেয়ার তো থাকতো অন্তত। ফটকে তালা লাগিয়ে শোক বই নিয়ে দৌড়ে গেলেন শিমুল বিশ্বাস-এ কেমন সৌজন্যতা?
ডা. দীপুমণি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নেত্রী,একটি দলের সভানেত্রী, সর্বোপরি একজন মা হিসেবে পুত্রহারা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন। একজন সন্তানহারা মা অসুস্থ হতেই পারেন, তাঁকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হতেই পারে। কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাবেন, সেটা বিকেল থেকেই জানানো হয়েছে বিএনপি নেতাদের। প্রধানমন্ত্রী গেলেন এবং ছয় মিনিট বন্ধ ফটকের সামনে অপেক্ষা করলেন। প্রধানমন্ত্রী গুলশানের কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার মাত্র ৫-১০ মিনিট আগে প্রধান ফটকে তালা দেয়া হলো কেন? বিয়োগান্তক ঘটনা যে কোন পরিবারে ঘটতে পারে। সমবেদনা জানাতে আসা একজন সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে যে সৌজন্য দেখানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে সেই ন্যূনতম সৌজন্য দেখাতেও বিএনপি নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন।এ ঘটনার কোন মন্তব্য বা ব্যাখ্যা প্রদানের ভাষা আমার জানা নেই।”
এছাড়া বিগত কয়েক বছরে একাধিকবার সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে সেনাকুঞ্জে গেলেও কথা বলেননি তাঁরা। ‘৯৭ সালে সদ্য প্রয়াত খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর বিয়ের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে আজকের মতোই ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর ক্লান্তিকালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সংলাপের জন্য খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দু’জনের মধ্যে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ফোনালাপ হলেও বরফ গলেনি, বরং সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বানচালে আন্দোলনের নামে সহিংসতা-ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। এরপরে দু’নেত্রীর মধ্যে আর কোন সাক্ষাত কিংবা কথা হয়নি।
এরমধ্যে গড়িয়ে গেছে অনেক জল। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর নেতৃত্বাধীন দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এখন যোজন যোজন দূরত্ব। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে বিরোধী দলের নেতার পদটিও হারিয়েছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। নির্বাচন বয়কটের আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল সহিংসতায় পাঁচ শতাধিক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, মানুষকে পুড়িয়ে মারার মহোৎসব প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ।
ঠিক এক বছর বাদে গত ৫ জানুয়ারি থেকে অবরোধ-হরতালের নামে একই কায়দায় মানুষ হত্যায় নেমেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। গত ৬ জানুয়ারি থেকে শনিবার পর্যন্ত ১৯ দিনে বিএনপি-জামায়াত জোটের নাশকতায় প্রায় ৩৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগে শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, দিনমজুর, ট্রাকচালকসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কঠোর অভিযান চালাচ্ছে। জাতীয় সংসদসহ সর্বত্র বিএনপি চেয়ারপার্সন জিয়াকে গ্রেফতারের জোরালো দাবি উঠেছে। অন্যদিকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি যদি বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়ে থাকেন তাহলে এই মুহূর্তে পুত্র হারানোর শোকের সান্ত্বনা দিতে খালেদা জিয়ার বাড়িতে যান। একই সঙ্গে দেশকে জ্বালাও পোড়াও থেকে রক্ষা করতে খালেদা জিয়াকে এই মুহূর্তে হরতাল-অবরোধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানান। শনিবার বিকালে উপজেলার ঘোনার চালা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কালিয়া ইউনিয়ন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, তারেক রহমান বিদেশের মাটিতে বসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজাকার’ বলে সাধারণ মানুষের মনে কষ্ট দেয়ায় হরতাল-অবরোধে মানুষ সাড়া দিচ্ছে না। তিনি তারেক রহমানকে এ সব কথা না বলে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন।
অন্য কাউকে দোষ দেবার আগে সেই টেলিসংলাপ থেকে ফটকে তালা ঝুলানো পর্যন্ত আচরণ জনগণের বিবেচনা করে ভাবতে হবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজে ন্যুনতম বিবেচনা বোধ ধারণ করেন কিনা। ২০১৩ টেলি সংলাপ এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনার সমবেদনা প্রত্যাখ্যানের জন্যে ফটকে তালা ঝুলানোর ঘটনার ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে খালেদা তাঁর ব্যক্তিস্বার্থ প্রশ্নে একেবারে আপোষহীন। যিনি নিজেই সামান্যতম ভদ্রতা দেখানো অপ্রয়োজনীয় মনে করেন- তাঁর কাছে দেশের প্রতি দায়িত্মশীলতা আশা করা বাতুলতা মাত্র।
লেখক, কনট্রিবিউটিং এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল