সেদিন ক্ষণে ক্ষণে ঝরছিল বৃষ্টি। কখনো থেমে থেমে, কখনো বা ঝড়োবেগে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেই আকাশভাঙা তুমুল বর্ষণ। দিনটি ছিল ১৯৮১ সালের ১৭ এপ্রিল। ঐতিহাসিক সেই দিনটিতে, বর্ষণমুখর বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামলেন শেখ হাসিনা; তখন তাঁর বুক ভেঙেও নেমেছিল অঝোরধারা। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে খুব কেঁদেছিলেন। তাঁর এ কান্না ছিল আনন্দের, বেদনারও।শেখ হাসিনা ছয় বছর আগে যখন জার্মানি গিয়েছিলেন, তখন দেশে সবাই ছিলেন। তাঁর বাবা-মা ছিলেন, ভাই ছিলেন, আত্মীয়স্বজন ছিলেন। জন্মভূমিতে যখন নামলেন, তখন তাঁর আপন আর কেউ নেই। গভীর শূন্যতা, হাহাকার নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বাইরে এসে দেখলেন, বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত লাখো মানুষ। স্বদেশবাসীর আবেগ সেদিন ছুঁয়েছিল, স্পর্শ করেছিল তাঁকে। তারপর সব হারিয়ে শেখ হাসিনা আপন করে নেন এ দেশের মাটি ও মানুষকে।
শেখ হাসিনার অনবদ্য রচনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ পড়তে পড়তে মনে হয়, বইটি শুধু পিতাকে নিয়ে কন্যার অনবদ্য স্মৃতিচারণা নয়, আমাদের ইতিহাসেরও অসামান্য এক দলিল। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। আমাদের মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অনেকেই গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু এ গ্রন্থে পাঠক বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও তাঁর পরিবারের অনেক অজানা ইতিহাস ও তথ্য স্থান পেয়েছে। তথ্যগুলো আগে কোনো বইয়ে প্রকাশিত হয়নি। এ ছাড়া বইটিতে স্থান পেয়েছে শেখ হাসিনার লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। বরেণ্য চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দীন আহমেদের চিত্রকর্ম অবলম্বনে বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মাসুম রহমান।
কলঙ্কিত ১৫ আগস্ট শুধু বাংলাদেশই পাল্টে দেয়নি, আমূল পাল্টে দিয়েছিল শেখ হাসিনার জীবনকে। দেশে ফিরে মর্মান্তিক পারিবারিক ট্র্যাজেডি সামলে উঠে দল গোছানো তাঁর জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বড় রাজনৈতিক দলের চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেলে, নেতৃত্বশূন্য হয়ে গেলে ওই দল গোছানো সহজ কথা নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণেই এত ঝড়ঝাপ্টার পরও আওয়ামী লীগ ঠিকই দাঁড়িয়ে যায় শক্ত ও দৃঢ় ভিত্তিমূলে। ১৯৮১ সাল-পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ শুধু উঠে দাঁড়ায়নি, দীর্ঘ ২১ বছর পর দলটি ফিরে পায় তুমুল জনপ্রিয়তা, জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গঠন করে সরকার।
বইটিতে শেখ হাসিনা নিজের লড়াই-সংগ্রামের কথা যেমন স্মৃতি থেকে তুলে এনেছেন, তেমনি মেলে ধরেছেন পারিবারিক নানা স্মৃতি-বিস্মৃতির কথা। অত্যন্ত সহজ-সরল ও ঝরঝরে ভাষায় বর্ণনা করেছেন, লিখেছেন জাতির জনকের অজানা নানা কথা। লিখেছেন ছোটবেলার কথা, মা-বাবার কথা, ভাইবোনের কথা।
বইটি পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে শেখ হাসিনার শৈশবের নানা প্রতিচ্ছবি। শুধু শৈশব নয়, তাঁর ছাত্রজীবন, ছাত্ররাজনীতি, নারীর সংসারজীবন, রাজনৈতিক পরিবারের প্রাত্যহিক শিক্ষা, সাংগঠনিক সংকটে আওয়ামী লীগের হাল ধরা, রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর দ্রুত দক্ষ হয়ে ওঠার পিতার কন্যাসুলভ ক্যারিশমা দেখানো, বিবিধ ষড়যন্ত্র মোকাবিলাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে তাঁর সাহসী কলমে।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়, লেখক হিসেবেও শেখ হাসিনার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। শত ব্যস্ততা, প্রতিকূলতার মধ্যেও সময় পেলেই তিনি বই পড়েন, লেখালেখি করেন। ইতিহাস ও রাজনীতির এক বাঁকবদলের সাক্ষী হিসেবে তাঁর রচনা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, অবশ্যপাঠ্যও। সুত্র-কালেরকণ্ঠ