‘ইবোলা’ এখন মূর্তমান ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কের নাম, যা একবিংশ শতাব্দীতে মানবজাতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। আফ্রিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে আমেরিকা-ইউরোপে ‘ইবোলা’ ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ সুদানে ১৯৭৬ সালের জুন মাস প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তারপর আরও কয়েকবার এ রোগের মহামারী দেখা দিলেও তা সুদান, কঙ্গো, জাইয়ার, উগান্ডা প্রভৃতি দেশে সীমাবদ্ধ ছিল। এ বছর মার্চ মাসে গিনিতে প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং পার্শ্ববর্তী লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিওনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে আফ্রিকার দেশগুলোর বাইরে আমেরিকা-ইউরোপে ‘ইবোলা’ আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। এবারের মহামারীতে এ পর্যন্ত আট হাজারের অধিক আক্রান্ত হয়েছে এবং চার হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। অত্যন্ত সংক্রামক হওয়ায় ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ এ রোগ নিয়ন্ত্রণে দুনিয়াজুড়ে সতর্কাবস্থা জারি করেছে। ‘ইবোলা’ ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ।
কারণ:
‘ইবোলা-ভাইরাস’ এ রোগের জন্য দায়ী। পাঁচ ধরনের ভাইরাস শনাক্ত হলেও, মূলত চার ধরনের ‘ইবোলা-ভাইরাস’ মানবদেহে এ রোগের কারণ। ভয়ঙ্কর এ রোগে আক্রান্তদের ২০-৯০ ভাগ মৃত্যুবরণ করে থাকে, গড়ে ৫০ ভাগ। তবে এবারের মহামারীতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার প্রায় ৭০ ভাগ।
কিভাবে ছড়ায় : ধারণা করা হয়ে থাকে এক ধরনের বাদুড়ের মাধ্যমে এ রোগ মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে। বাদুড় ছাড়াও গরিলা, শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব আছে। সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে বা মাংস খেয়ে এ রোগ মানবদেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত রোগীর লালা, বমি, মল-মূত্র, ঘাম, অশ্রু, বুকের দুধ এবং বীর্যের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। আক্রান্তদের ব্যবহার করা সুই, সিরিঞ্জ এমনকি কাপড়ের মাধ্যমেও ছড়ায়। নাক, মুখ, চোখ, যৌনাঙ্গ বা ক্ষতের মাধ্যমে এ রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। রোগাক্রান্তরা সুস্থ হয়ে গেলেও, ৭ সপ্তাহ পর্যন্ত বীর্যের মাধ্যমে অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে। মৃতদের মাধ্যমেও ছড়ায়।
লক্ষণ:
ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ২-২১ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে, গড়ে ৭-১০ দিন। প্রাথমিকভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো জ্বর, ক্ষুধামন্দা, গা ব্যথা, মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কাশি ইত্যাদি দেখা দেয়। এর পরে বমি, পাতলা পায়খানা এবং ত্বকে লক্ষণ প্রকাশ পায়। নাক, মাড়ি, চোখ, বমিতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ত্বকে রক্তক্ষরণের কারণে এক ধরনের ছোপ ছোপ লালচে ক্ষত দেখা দেয়, কাশি এবং মলেও রক্তক্ষরণ হয়। শরীরের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে থাকে, লিভার ও কিডনির কার্যক্ষমতাও কমতে থাকে। এ রোগের কিছু লক্ষণ ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুজ্বরের মতো মনে হতে পারে। ৮-১২ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়ে থাকে। যারা বেঁচে যান তাদের অনেকদিন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। দুর্বলতা এবং অস্থি জোড়ার ব্যথা রোগ প্রশমনের দীর্ঘকাল পরও পরিলক্ষিত হয়।
রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা:
সাধারণত ভ্রমণের ইতিহাস এবং রক্ত পরীক্ষার মাধমে এ রোগ শনাক্ত করা হয়। ভাইরাসজনিত রোগ বিধায় এ রোগের সঠিক কোনো চিকিৎসা নেই। লক্ষণ অনুযায়ী নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়েথাকে, যেমন : পানিশূন্যতার জন্য স্যালাইন, রক্তক্ষরণের জন্য রক্তের প্লাজমা, ডায়ালাইসিস, এন্টিবায়োটিক, এন্টিভাইরাল ইত্যাদি দেওয়া হয়ে থাকে।
প্রতিরোধ:
এ রোগ প্রতিরোধে সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। দেশে প্রবেশের বন্দরসমূহে রোগী শনাক্তকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তাদের এ রোগ সম্বন্ধে প্রশিক্ষিত করতে হবে। সাধারণ জনগণকে ‘ইবোলা’ সম্বন্ধে সচেতন করতে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। এ রোগের প্রতিষেধক টিকা এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।
ডা. এম আর করিম রেজা
সিনিয়র কনসালটেন্ট, চর্ম, এলার্জি ও কসমেটিকজনিত রোগ
এশিয়ান জেনারেল হসপিটাল লিমিটেড, ঢাকা। ফোন : ০১৭১৬-২৮৯৮৮৭
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন