পাটুরিয়া ঘাট থেকে দৌলতদিয়ায় যাওয়ার পথে মাঝপদ্মায় লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত ১৪ শিশু ও ২১ নারীসহ ৭০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৯ জন বলে জানিয়েছে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসন।
এদিকে গতকাল রোববার রাত প্রায় পৌনে ১২টা নাগাদ নদী থেকে লঞ্চ উদ্ধার অভিযান শুরু করে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম। এর পর দিবাগত রাত ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে লঞ্চটিকে পাড়ে টেনে আনা হয়। সে সময় লঞ্চের ভেতর থেকে ২৩টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
আজ বেলা পৌনে ১১টার দিকে লঞ্চের ভেতরের উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস। তিনি জানান, লঞ্চের ভেতরে আর কোনো লাশ না থাকায় এর ভেতরের উদ্ধারকাজ সমাপ্ত করা হলো। তবে নদীতে লাশের সন্ধানে উদ্ধারকাজ চলবে। যখন তাঁরা নিশ্চিত হবেন যে আর কোনো লাশ নদীতে নেই, তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার অভিযান শেষ করা হবে।
সোমবার সকাল পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ৭০ লাশের মধ্যে ৬৯টি লাশ শনাক্ত করেছে তাদের স্বজনরা। বাকি ১টি লাশ শনাক্ত না হওয়ায় লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে নিখোঁজেরস্বজনরা সেখান থেকে লাশটি শনাক্ত করতে পারবেন।
লঞ্চটিতে শতাধিক যাত্রী ছিলেন বলে জানা গেছে। যার মধ্যে ৫০-৬০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
উদ্ধার হওয়া ৭০ লাশের মধ্যে ১৪ জন শিশু, ২১ জন নারী ও ৩৫ জন পুরুষ। এদের মধ্যে ২৮ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন-মাগুরার লাইলী আক্তার (৬৫), রাজবাড়ীর ইমরান (৮), নবীজান (৭০), রাবেয়া বেগম (৫০), নাসিমা আক্তার (৩৬), ইমামুল ইসলাম (১৫), অসীমা রাণী (৪০) ও ফারজানা আক্তার (৩০); পাবনার ফজলুর রহমান খান (৫৫); মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের সেলিম হোসেন (২৮), লাবনী আক্তারমুক্তা (১৫); কুষ্টিয়ার নাসিরউদ্দিন (৪০), মধুসূধন সাহা, রেবেকা খাতুন (৫০) ও মেহেদী হাসান (৩০); কুমারখালী, কুষ্টিয়ার সাবু (২০) ও বিথী খাতুন (৩৫); ফরিদপুরের নার্গিস আক্তার (১৫), পাপন (০৫), রতন কুমার সরকার (৩২) ও অর্চনা মালো (৪৫); নগরকান্দা, ফরিদপুরের বাধন সরকার (৮), শিবালয়, মানিকগঞ্জের লতা আক্তার (২২), নড়াইলের হাফছা (৮) ও আমেনা বেগম (৩০), গোপালগঞ্জের জুনায়েদ শেখ, এবং কুমিল্লার আবুল হাসান (৬০) ও পরিমল ভৌমিক।
লাশের সংখ্যা আরো বাড়তে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এখনো ৯ জনের নিখোঁজ থাকার কথা বলছে প্রশাশন। গত রাতে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), স্থানীয় উদ্ধারকারী জাহাজ আইটি-৮৩৮৯, নৌবাহিনীর ১১ ডুবুরির একটি দল ও প্রশাসনের লোকজন ট্রলার নিয়ে নদীতে উদ্ধার অভিযান চালান।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে রবিবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে ‘এমভি নারগিস’ নামে একটি সারবাহী কার্গোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে ‘এমভি মোস্তফা’ নামের লঞ্চটি ডুবে যায়।
এদিকে, লঞ্চডুবির ঘটনায় দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দুটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পাটুরিয়া ঘাটে একটি মেডিকেল সেন্টার খুলেছে। স্বজনদের কন্টোল রুমে সরাসরি অথবা ০১৭১৮-৮৩০৮৯৫ এই মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. খন্দকার শামসুজ্জোহা, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এ এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, নৌ পুলিশের ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান, মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) রাশিদা ফেরদৌস, পুলিশ সুপার (এসপি) বিধান ত্রিপুরা, রাজবাড়ীর ডিসি মো. রফিকুল ইসলাম খান ও এসপি তাপতুন নাসরীন ঘটনাস্থলে যান।
গতকাল বিকাল ৫টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, প্রাথমিকভাবে নিহতের স্বজনদের দেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। তালিকা প্রস্তুতির পর আরও দেওয়া হবে ১লাখ ৫ হাজার টাকা।
লঞ্চডুবির ঘটনা তদন্তে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে এই কমিটিকে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় রোববার বিকেলে এ বিষয়ে একটি আদেশ জারি করেছে।
বিআইডাব্লিউটিএ চেয়ারম্যান জানান, ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমভি মোস্তফা ও ধাক্কা দেওয়া কার্গো এমভি নারগিস এর মধ্যে প্রতিযোগিতার কারনেই মুলত এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। তারা উভয়য়েই মনে করেছিল একে অন্যকে কাটিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে।
এদিকে পাটুরিয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবদুল মুকতাদির জানান, ‘ইতোমধ্যে ৫০-৬০ যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিরা সাঁতরে তীরে উঠেছেন।’
মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, যে সারবোঝাই কার্গোটি লঞ্চটিকে ধাক্কা দিয়েছিল, এর মাস্টার ও তাঁর দুই সহকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জের ঘিওর ফায়ার সার্ভিস অফিসের ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর জিহাদ মিয়া জানান, ‘ডুবে যাওয়া লঞ্চটি ৩৫-৪০ ফুট গভীরে রয়েছে। লঞ্চের সামনের দিকটা রয়েছে নিচের দিকে।’
ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে সাঁতরে তীরে উঠা এক যাত্রী জানান, ‘মাঝ নদীতে পৌঁছানোর পর বাম দিক থেকে এসে কার্গো জাহাজটি তাদের লঞ্চকে ধাক্কা দেয়। এতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডান দিকে কাত হয়ে লঞ্চটি ডুবে যায়।’
এসময় লঞ্চটিতে শতাধিক যাত্রী ছিলেন বলে জানান মৃত্যু থেকে ফিরে আসা ভাগ্যবান এয় যাত্রী।
লঞ্চ ডুবির পর দুপুর সাড়ে বারটায় বিআইডাব্লিউটিএ’র ট্রাফিক পরিদর্শক দীনেশ কুমার সাহা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ‘পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই কার্গোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে লঞ্চটি ডুবে যায়। তবে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি।’
ডুবে যাওয়া লঞ্চটিতে দুটি বাসের যাত্রী ছিল বলে জানা গেছে, যারা মুলত ঢাকা থেকে বাসে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত যায়। এরপর লঞ্চে দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছে আবার বাসে করে তাদের গন্তব্যে রওনা হবার কথা ছিল।