টেলিফোন কথোপকথনে সরকার উৎখাতে সামরিক হস্তক্ষেপে আগ্রহ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ চাওয়ার কথা প্রকাশের পর তীব্র সমালোচনার মুখে থাকা মাহমুদুর রহমান মান্নাকে মঙ্গলবার ভোররাতে আটক করা হয়েছে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
তবে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্নাকে আটক বা গ্রেপ্তার কোনোটাই করা হয়নি বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
রাজধানীর বনানীর একটি বাসা থেকে মঙ্গলবার ভোররাতে তাকে আটক করা হয়েছে বলে জানান তার স্ত্রী মেহের নিগার।
মেহের নিগার মঙ্গলবার ভোর ৫টায় গুলশান-২ এর নিজ বাসায় সাংবাদিকদের জানান, ‘ওই দিন তার স্বামী বনানীর ই-ব্লকের ১২ নম্বর বাসায় ছিলেন। বাসাটি মান্নার ভাতিজি শাহনামা শারমিনের। ওই বাসা থেকে রাত ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তার স্বামীকে আটক করে নিয়ে যায়। শাহনামা শারমিন রাত সোয়া ৩টার দিকে ফোন করে তাকে এ কথা জানান।’
মান্নার ভাতিজি শাহনামা শারমিন ভোর সাড়ে ৫টায় তার নিজ বাসায় সাংবাদিকদের জানান, ‘রাত ৩টার দিকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে কয়েকজন তাদের বাসায় কড়া নাড়েন। এ সময় তার চাচা (মান্না) ঘুমিয়েছিলেন। ডিবি পুলিশ তাকে জানায়, তারা মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়ে যেতে এসেছে।’তিনি জানান, ‘এ সময় তার চাচাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে এ খবর জানানো হয়। তিনি ঘুম থেকে উঠে ডিবি পুলিশের কাছে পোশাক পরার সময় চান। পোশাক পরা শেষ হলে পুলিশ তাকে নিয়ে চলে যায় বলে জানান শাহনামা শারমিন।’
তবে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে ডিবি পুলিশ তাদের কিছু জানায়নি। এর আগে মান্না রাত ১১টার দিকে তাদের বাসায় আসেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই বলে পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার নূর আলম জানিয়েছেন।
আর সকাল সাড়ে দশটায় ডিএমপি কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, “মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আটক বা গ্রেপ্তার কোনোটাই করা হয়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বাইরে আরও অনেক ইউনিটের লোকজন গ্রেফতার করতে পারে। তারাও নিয়েছে কিনা আমরা সে ব্যাপারে সঙ্গে যোগাযোগ করবো।”
তিনি আরও বলেন, “তার পরিবার যদি আইনগত সাহায্য চায় তবে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তা করব। যে কোনো নাগরিকের আটক কিংবা মিসিং হওয়ার বিষয় আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে থাকি। তার বিষয়টিও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।”
ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৫১ মিনিটে মোবাইল ফোনে পাঠানো এক খুদেবার্তায় জানান, মান্নাকে ডিএমপি আটক করেনি।
এর আগে রবিবার ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তির সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপের অন্যতম উদ্যোক্তা মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপের অডিও টেপ ফাঁস হয়।
এতে মান্নাকে চলমান পরিস্থিতিতে সেনা হস্তক্ষেপের উদ্যোগে আগ্রহ প্রকাশ করতে শোনা যায়। পাশাপাশি বিএনপি জোটের আন্দোলন জোরদারে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার কথাও বলতে শোনা যায় তাকে। এই অডিও টেপ ফাঁস হওয়ার পর এ নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠেছে।
সরকার উৎখাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দুই-তিনটা লাশ ফেলে দেওয়ার’ কথা বলায় ষড়যন্ত্রের দায়ে মান্নাকে গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
মান্নাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাকে দেখা মাত্রই ‘ধোলাইয়ের’ ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক নেতা মান্না ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বাদ পড়ার পর বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান ও টেলিভিশন টক শো-তে সরব ছিলেন।
নাগরিক সমাজের হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্বকারী মান্নার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে।
গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোট অবরোধ ডাকার পর সহিংসতায় প্রাণহানির মধ্যে ড. কামাল, মান্নার উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানানো হয়।
সংলাপ না হলে আবারো ওয়ান ইলেভেন হওয়ার কথাও বলেছিলেন তিনি।
সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের কথা উঠলে নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন মান্না। ২০১২ সালে আত্মপ্রকাশ করা নাগরিক ঐক্য প্রথমে নাগরিক সংগঠন হিসেবে কাজ শুরু করলেও এটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠছে।
ছাত্রলীগ থেকে জাসদ, বাসদ, জনতা মুক্তি পার্টি হয়ে আওয়ামী লীগে ফেরা মান্না ২০০৭ সালে রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের পর সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি পান।
সে সময় দুই নেত্রীকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা, যা মাইনাস টু ফর্মুলা হিসেবে পরিচিত, তাতে মান্নার সক্রিয় ভূমিকার কথা বেশ আলোচিত। এজন্য তাকে ওয়ান-ইলেভেনের ‘কুশীলব’ বলেন আওয়ামী লীগ নেতারা।