ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন জড়িতদের অন্যতম শফিউর রহমান ফারাবীকে গ্রফতার করেছে র্যাব। সোমবার সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার তদন্ত কর্তৃপক্ষ- ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে তাকে হস্তান্তর করেছে র্যাব। এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে র্যাব।
এদিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করতে ১৮টি সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে (র্যাব)। বইমেলা ও আশপাশ এলাকার মোট ৪০টি সিসি ক্যামেরার মধ্যে ওই ১৮টি ক্যামেরায় অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার সঙ্গে সন্দেহভাজন পাঁচজনকে ঘুরাফেরা করতে দেখা গেছে। সন্দেহভাজন ওই পাঁচজনকে শনাক্ত করতে র্যাব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে অভিজিতের হত্যার ঘটনায় তার আহত স্ত্রী ডা. রাফিদা আহমেদ বন্যার সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে। এই তথ্য জানিয়েছেন অভিজিতের ছোট ভাই অনুজিৎ রায়ের স্ত্রী কেয়া বর্মণ। তিনি গতকাল টেলিফোনে বলেন, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে বন্যাকে আমেরিকায় ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
বন্যাকে সরাসরি হাসপাতাল থেকে এয়ারপোর্টে নেয়া হবে। তবে কোন ফ্লাইটে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন, সেই বিষয়টি তারা জানেন না। আমেরিকায় পৌঁছানোর পর সেখানকার একটি চিকিৎসক দল তাকে গ্রহণ করবেন। প্রসঙ্গত বন্যা যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক। অভিজিতের হত্যার ঘটনায় বন্যা আহত হওয়ার পর তিনি রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনার সময় তিনি উপস্থিত থাকায় অভিজিৎ হত্যা মামলার একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বন্যার চলে যাওয়ার বিষয়টি তাদের অবহিত করা হয়নি। বন্যা অসুস্থ থাকায় তদন্ত কর্মকর্তা তার সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কথা বলতে পারেননি। তদন্তের স্বার্থে বন্যার বক্তব্য নেয়া খুবই জরুরি। তিনি চলে গেলে, মামলার তদন্ত কাজ ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
র্যাব বলেছে, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুক, ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফারাবীর নাম আলোচনায় আসে। এর আগে ২০১৪ সালের মার্চে এ ফারাবী অনলাইনে বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান- রকমারী ডটকমকে হুমকি দিয়ে বলেন, অভিজিৎ রায়ের বই বিক্রি করা যাবে না। একই সঙ্গে তাদের ওয়েবসাইট থেকে অভিজিৎ রায়ের বই তুলে নেয়ার জন্য বলেন। হুমকির মুখে প্রতিষ্ঠানটি ওই সময় তাদের ওয়েবসাইট থেকে অভিজিৎ রায়ের বই তুলে নিতে বাধ্য হয়। ফারাবী এর আগে ফেসবুক পোস্টেও বেশ কয়েকদফা অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেন। গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠন ব্লগার রাজিব হায়দার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্তার অভিযোগে গত বছর ফারাবীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তবে কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে ছাড়া পান তিনি।
ফারাবীকে গ্রেফতারের পর সোমবার র্যাব সদরদফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক দিন ধরেই অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিলেন ফারাবী ও তার গ্রুপের লোকজন। গত বছর ৯ ফেব্র”য়ারি ফারাবী তার ফেসবুকে বন্ধু মান্নান রাহীকে উদ্দেশ করে লেখেন, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে।’
অভিজিতের হত্যাকাণ্ডে ফারাবীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল বলেন, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্যতম প্রধান সন্দেহভাজন ফারাবী। তার সঙ্গে অনেক উপ্রপন্থীর যোগাযোগ রয়েছে। এর আগেও তাকে প্রেফতার করা হয়েছিল। আর এবার গা-ঢাকা দেয়ার আগেই ফারাবীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ৪-৫ বছর আগে ফারাবীর সঙ্গে অভিজিতের ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। তবে আদর্শের মিল না থাকায় অভিজিৎ দুই বছর আগে ফারাবীকে ব্লক করে দেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে ফারাবী ফেসবুকে অভিজিতের পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ করে বিভিন্ন হুমকিমূলক মন্তব্য করতেন। বিভিন্ন ছবি পোস্ট করতেন। সংবাদ সম্মেলনের আরও জানানো হয়, গ্রেফতারকৃত ফারাবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতেন। তবে তিনি শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। ২০১০ সালে নিষিদ্ধ উপ্রপন্থী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা এখনও স্বীকার করেননি ফারাবী। তবে কোনো অপরাধীই প্রথমে অপরাধ স্বীকার করতে চায় না। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তথ্য উদ্ধার করতে হয়। ফারাবীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এখনই তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না।
র্যাব জানায়, ব্লগে লেখালেখির সূত্র ধরেই অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে ফারাবীর পরিচয় হয়। উগ্রপন্থী লেখালেখি থেকে সরে আসতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফারাবীকে অনুরোধ করেন অভিজিৎ। তবে ফারাবী সে কথা রাখেননি। ফারাবীর দাবি- গত দুই বছর ধরে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই।
এদিকে বইমেলা এলাকায় স্থাপিত ৪০টি সিসি টিভির মধ্যে ১১টি সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কারী সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পাশপাশি র্যাবও বইমেলার ভিডিও ফুটেজ থেকে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে।
সোমবার সকালে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগে আলাপকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘অভিজিৎ রায়ের ঘাতকদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজে হাজার হাজার মানুষের ভেতর থেকে ঘাতকদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তে দেশের অন্য যে কোনো সংস্থা কিংবা বিদেশী সংস্থা সহযোগিতা করতে চাইলে আমরা স্বাগত জানাব।’
২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে অমর একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি এলাকায় ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় গুরুতর আহত রাফিদা আহমেদ বন্যা এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিৎ রায়কে হত্যার ঘটনায় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহায়তা দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যা স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ।