বিএনপি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিনটি নিয়ে উদাসীন হলেও দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান স্বীকার করেছিলেন দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা।
১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত এক লেখায় জিয়া নিজেই লেখেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল তার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা।
এখন বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনকের স্বীকৃতি দিতে বিএনপির আপত্তি থাকলেও ওই লেখায় জিয়া নিজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বলে উল্লেখ করেন।
শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কীভাবে বিষোদগার করা হত, তাও উঠে এসেছে জিয়ার লেখনীতে।
লেখায় মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর জিয়ার আস্থাও ফুটে উঠেছে। তিনি নিজেই লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ ও ‘৭০ এর নির্বাচনে রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা। বলেছেন, ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বিদ্রোহের পর তিনি নিজেই আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৭৪ সালে স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় জিয়াসহ মুক্তিবাহিনীর তিন ফোর্সের অধিনায়কের স্মৃতিকথা ছেপেছিল। অন্য দুজন হলেন খালেদ মোশাররফ ও কে এম সফিউল্লাহ।
‘মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত ত্রয়ী ও তাদের স্মৃতিকথা’ শিরোনামের এই অংশে প্রকাশিত তিনটি লেখাই ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক গণবাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল বলে বিচিত্রায় উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে বিচিত্রাসহ তিনটি পত্রিকায় বিলুপ্ত।
‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামের ওই লেখায় জিয়া লেখেন, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোম্মুখ হয়ে উঠলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালি কর্মকর্তারাও তার আঁচ পেতে থাকে। ভেতরে ভেতরে আলোচনা চলতে থাকে।
“৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হল। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম,” লিখেছেন জিয়া।
রেসকোর্স ময়দানে ওই ভাষণেই বঙ্গড়বন্ধুর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় বাঙালির মনের কথা- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও ওই দিনই স্বাধীনতার ডাক বঙ্গবন্ধু ইঙ্গিতে দিয়েছিলেন বলে মনে করেন তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সব বাঙালি, যা জিয়ার লেখায়ও স্পষ্ট।
লাখো মানুষের মহাসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে; যা অনুসরণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের মহড়া শুরু করে দেয় ছাত্র সংগঠনগুলো, যাতে বিপুল সংখ্যক ছাত্রীর উপস্থিতি প্রেরণা যোগায় সবাইকে।
তবে এরপর বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের আলোচনা শুরুকে পরিস্থিতির উন্নতি বলে মনে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক জিয়া। কিন্তু তা আর হয়নি।
রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যায়, সেই সঙ্গেই শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ, শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।
জিয়া লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন তার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। আর বিদ্রোহের পরই তিনি বিষয়টি জানাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
“সমস্ত পাকিস্তানি অফিসারকে বন্দি করলাম।… রিং করলাম বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ করলাম ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা,” লিখেছেন জিয়া। তবে গোলযোগপূর্ণ ওই সময়ে কারো সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি অপারেটর।
এরপর আসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, যা চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের ব্যবস্থা করেন বেলাল মোহাম্মদসহ দুঃসাহসী কয়েকজন। এতে পরে সংশ্লিষ্ট হন জিয়াউর রহমানও।
বিএনপি দাবি করে আসছে, জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তবে বেলাল মোহাম্মদ এই বিষয়টি স্পষ্ট করে ২০১০ সালে বিডিনিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। এরপর করেছিলেন জিয়া।
স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের বিষয়ে জিয়ার সম্পৃক্ততা তুলে ধরে বেলাল বলেন, “আমি তখন কী মনে করে উনাকে (জিয়া) বললাম, মেজর, এখানে তো আমরা সবাই মাইনর, একমাত্র আপনিই মেজর। আপনি কি নিজের কণ্ঠে কিছু বলবেন।
“তারপর তাকে কাগজ দেওয়া হলে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন।”
বিচিত্রার যে সংখ্যায় জিয়ার লেখা ছাপা হয়েছিল, সেই সংখ্যায় ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের লেখায়ও উল্লেখ রয়েছে, মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন শেখ মুজিবের পক্ষে।
মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়টি বিএনপি নেতারা সবসময় উপেক্ষা করে এলেও জিয়ার লেখায় স্পষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি তার আস্থা।
জিয়ার লেখার শুরুই হয়েছিল এভাবে- “পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মি. জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, আমার মতে সেদিনই বাঙালি হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ।”
পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গীদের অস্বচ্ছতা অল্পবয়সেই পীড়া দিত বলে উল্লেখ করেছেন জিয়া। সামরিক বাহিনীতে যাওয়ার পর এই অনুভূতি আরো গাঢ় হয়।
জিয়ার ভাষায়- “আমাদের ওরা দাবিয়ে রাখত, অবহেলা করত, অসম্মান করত, বলত- ‘আওয়ামী লীগের দালাল’। একাডেমির ক্লাসগুলোতেও সবসময় বোঝানো হত- আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন ওদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু।”
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সৈন্যদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার আগে থেকে ভারতীয় সৈন্যদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণার কথাও লিখেছেন জিয়া।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তার লেখায় বলা হয়েছে- “যুদ্ধবিরতির সময় বিভিন্ন সুযোগে আমি দেখা করেছিলাম বেশ কিছু সংখ্যক ভারতীয় অফিসার ও সৈনিকের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করেছি, হাত মিলিয়েছি। তখন দেখেছিলাম, তারা অত্যন্ত উঁচু মানের সৈনিক।
“তাদের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল, আমরা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলাম। এই প্রীতিই দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পাশাপাশি ভাইয়ের মতো দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে আমাদের।” বিডিনিউজ প্রতিবেদন’১২