আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) নির্বাচনে দক্ষিণ থেকে মেয়র প্রার্থী হতে যাচ্ছেন সাঈদ খোকন। দল থেকে এরই মধ্যে সমর্থনও পেয়েছেন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের এই সাংগঠনিক সম্পাদক। গত ৩ মার্চ রাজধানীর বনানীতে নিজ বাসা ‘ফাতেমা হানিফ’এ বসে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন তিনি। এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগ ছেড়ে কিংস পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন সাঈদ খোকন। কথায় কথায় উঠে আসে বিষয়টিও। বলেন, পরিস্থিতির শিকার ছিলেন তিনি। পাশাপাশি বললেন, ‘বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ এই ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। তাকে দেখেছি কীভাবে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হয়। বাবার শিক্ষাই আমার কাছে বড়। তাই কোনো দলের নয়, সবার মেয়র হবো।’ আলাপচারিতায় ছিলেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও তানিম আহমেদ।
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দক্ষিণ থেকে মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন। কেন ঢাকার অভিভাবক হওয়ার ইচ্ছে হল?
ঢাকা শহরের মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক অর্ধশতাব্দীর। আমার নানা মাজেদ সরদার ছিলেন ঢাকার শেষ সরদার। বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ ঢাকার নির্বাচিত প্রথম মেয়র। আমি তৃতীয় প্রজন্ম। ঢাকার মানুষের সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরেই আমরা ঢাকাবাসীর পাশে আছি। সেই পারিবারিক ধারাবাহিকতা থেকে মেয়র হওয়ার ইচ্ছে, এটা বলতে পারেন।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়টা কীভাবে?
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আমার পরিচয় পরিবার থেকেই। সাংগঠনিক ভাবে আছি ১৫ বছর ধরে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছি একযুগেরও বেশি সময় ধরে।
মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন আছে আপনার সঙ্গে…
ঢাকাবাসীর সঙ্গে আমাদের যে আবেগের সম্পর্ক রয়েছে সেই স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এই স্বীকৃতির জন্য পরিবার এবং ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
২০১২ সালে ডিসিসি নির্বাচনেও তফসিল ঘোষণার পর মনোনয়ন কিনেছিলেন। তখন কি দলের সমর্থন আপনার সঙ্গে ছিল?
তখনও প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন তুমি নির্বাচনের প্রস্তুতি নাও। তার আশ্বাস পেয়েই মনোনয়নপত্র কিনেছিলাম।
তিলোত্তমা ঢাকাকে দৃষ্টি নন্দন করতে আপনার পরিকল্পনা কী?
এখন নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজ করছি। ঢাকাবাসীর জন্য আমাদের ভিশন-মিশন কী হবে সেটা ঠিক করছি। তফসিল ঘোষণার পর ইশতিহার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবো।
এখন কি নির্বাচনী জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন?
নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি। স্থানীয় নেতাদের কাছে দোয়া চাইছি। সালাম বিনিময় করছি।
ঢাকার একজন মেয়রের ক্ষমতা কি নগর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথেষ্ট?
এখানে ক্ষমতার কোন দ্বন্দ্ব নেই। আমার তো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, বাবার কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে ঢাকাকে পরিচালনা করার জন্য একটি মেট্রোপলিটন গভর্মেন্ট (নগর সরকার) করতে চেয়েছিলেন।
ওই সরকারের দায়িত্ব কী হবে?
সেবা প্রধানকারী সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় থাকবে। এখন দেখা যায়, একটি রাস্তায় একবার টেলিফোন তারের জন্য কাটা হয়, ঠিক করার কিছুদিন পর আবার বিদ্যুৎ, গ্যাসের লাইনের জন্য কাটা হয়। একই রাস্তা সারা বছর ধরেই খোঁড়াখুড়ি চলে। যদি এই সব সংস্থাগুলো একটি কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকতো তবে সব সমস্যা একবারের সমাধান করা যেত।
এই সমন্বয়ের আর কি সুফল পাওয়া যাবে?
সমন্বয়ের অভাবে কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা আমরা এখন দেখতে পারছি। নাগরিক সমস্যা সমাধানের জন্য সবকিছুর সমন্বয় করা প্রয়োজন তাতে নাগরিকদের লাভ হবে।
মেয়রের পক্ষে এসব সমন্বয় করা সম্ভব?
সম্ভব। তবে আইনগত এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাতো অবশ্যই রয়েছে। তা না হলে এটা এতদিনে হয়ে যেত।
এ ব্যাপারে আপনার কোনো উদ্যোগ থাকবে?
সেটা আরো পরের বিষয়। এখন চিন্তা করছি না।
ঢাকা দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে, এমন কথা শোনা যায়। আপনি কী মনে করেন?
কদিন আগে বিভিন্ন মানব উন্নয়নের সূচকেও বিষয়টি দেখলাম। বড়বড় শহরের উপর বিভিন্ন সংস্থার জরিপে ঢাকার অবস্থান বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় র্শীষে। সেই তালিকা বাদ দিয়ে নিজের দেশের কথা ভাবি। দেশের অনেক মফস্বল এবং জেলা শহর বসবাসের জন্য ঢাকার তুলনায় অনেকবেশি আরামদায়ক । তবে সেই শহরগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা চাকুরির সুবিধা কম। সেই দিক বিবেচনা করলোও ঢাকা শহর অনেক পিছিয়ে।
তাহলে ঢাকামুখী মানুষের চাপ বেশি কেন?
আমাদের কাজ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য নগরজীবন উপভোগ করতে চাই। এজন্যই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন ঢাকায় আসেন।
তাহলে ঢাকাকে বাসযোগ্য করার উপায় কী?
ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বেশি কিছু করার প্রয়োজন পড়ে না। সবাই মিলে চেষ্টা করলেই সম্ভব। আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবে ঢাকাকে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দেওয়া এবং বসবাসের যোগ্য করে তোলা।
আপনি একটি দলের সমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। নির্বাচিত হলে দল নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করবেন কীভাবে?
এই প্রশ্নের পর আমার বাবার কথা মনে পড়ছে। তার নির্বাচনের ওয়াদা ছিল সিটি কপোরেশনকে দলীয়করণ মুক্ত করবেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে?
তিনি বিভিন্ন সম্মেলনে যোগ দিতে বিদেশ যেতেন। সেখানে কীভাবে নগর পরিচালনা হয় তা জানার চেষ্টা করতেন। আবার অনেকবার দেখেছি তার অবর্তমানে বিএনপি সমর্থিত কমিশনারকে মেয়ারের চেয়ারে বসিয়ে যেতেন। মেয়র হিসাবে তিনি কখনো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেখাননি। সেইজন্য আমার বাবাকে সবাই সন্মান করে।
নির্বাচিত হলে আপনি কী করবেন?
বাবার জীবন আমার জন্য বড় শিক্ষা। নির্বাচিত হলে তার মতো দল নিরপেক্ষ থেকে কাজ করবো। সবার মেয়র হবো। কোনো দলের নয়।
ঢাকার ছিন্নমূল মানুষের বাসস্থান ও বস্তি সমস্যা সমাধানে কোনো পরিকল্পনা থাকবে?
পুরানো ঢাকায় তুলনামূলক বস্তি কম। অনেককে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। যে বস্তিতে থাকে সেও একজন মানুষ, এই দেশেরই সন্তান। আপনি একজন বস্তিবাসীকে আশ্রয়হীন করে দেবেন সেটাতো হতে পারে না। তাই হঠাৎ করে তাদের সরিয়ে দেয়া যাবে না। তার আগে পূর্নবাসন করতে হবে। আমি পরিস্কার ভাবে বলতে চাই সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের গুরুত্ব আমার কাছে সবচেয়ে বেশি।
দল থেকে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস কি পাচ্ছেন?
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে সেটাইতো আমরা চাই। জনগণের পছন্দের তালিকা বড় হলেই জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। তা না হলে তো সেটা নির্বাচন হয়না। আওয়ামী লীগ একটি সুশৃঙ্খল বড় দল। এখানে বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হয় না। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে তবে বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না।
বিএনপি ডিসিসি নির্বাচনে আসার ব্যাপারে এখনও কোনো ঘোষণা দেয়নি। আপনি কি মনে করেন বিএনপির নির্বাচনে আসা উচিত?
আমরা সবসময় বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানাই । নির্বাচনের মাধ্যমে তারা সুস্থ্য ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসুক। দেশের সব জনগণই সেটা আশা করে।
১/১১-র সময়ে আপনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে কিংস পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। এনিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনা আছে…
আমি পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। দলের সভানেত্রীসহ সিনিয়র সব নেতাই জানতেন। তারা ঘটনার আগে পরের বিষয়ও জানেন। তাদের কাছে আমি আগে যেমন ছিলাম এখনও তেমন আছি।
সংসদ সদস্য হাজী সেলিম নির্বাচন করতে পারেন শোনা যাচ্ছে। এতে আপনার কোন সমস্যা হবে কিনা?
দলের পক্ষে থেকে আমাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। আমাদের কর্মসূচি নিয়ে আমরা মাঠে আছি এবং জনগণের কাছে যাচ্ছি। জনগণকে সংগঠিত করে দলের আস্থার প্রমাণ দিতে চাই। এখানে কে, কোথায়, কি আসলো, কি করলো সেটা দেখা আমার কাজ নয়। সেটা দেখার বিষয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের।
আপনি থাকেন ডিসিসি উত্তরে। কিন্তু প্রার্থী হচ্ছেন দক্ষিণে। নির্বাচিত হলে কি আপনি দক্ষিণে যাবেন নাকি জনগণকে এখানে আসতে হবে?
আমার পৈত্রিক বাসা কিন্তু দক্ষিণে। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার মা এই বাসায় থাকেন। মায়ের বুক বলতে তো একটা কথা আছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই এলাকায় থাকি। মায়ের সঙ্গে থাকার জন্যই রাতে এখানে আসি। জনগণের যেমন দাবি আছে তেমনি মায়েরও তো দাবি আছে। এই ছাড়টুকু আমি জনগণের কাছে পাবো বলে বিশ্বাস করি।