বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলোচনা হবে বলে আশা করেছিল। লে. জেনারেল টিক্কা খানের হেলিকপ্টার মহড়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়া শিগগিরই আসছেন বলে চারদিকে খবর ছড়িয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট লোকজনও জানতেন, ৭ মার্চের ভাষণের প্রাক্কালে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ঢাকায় এসে তার দাবিগুলো পূরণ করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। কিছু সময়ের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সংযত হওয়ার আবেদন জানান ইয়াহিয়া খান এবং বিশেষ করে একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। ইয়াহিয়া আরো অঙ্গীকার করেন যে তিনি ১০ মার্চ ঢাকা আসছেন এবং আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিরূপণ করা হবে।
একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণাসহ সব ফ্যাক্টর বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু সম্মতি প্রকাশ করেন এবং একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি খারাপ শব্দ। দক্ষিণ রোডেশিয়ার (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) তৎকালীন ‘বিদ্রোহী’ প্রধানমন্ত্রী আয়ান স্মিথের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা বাস্তবায়িত হতে অনেক সময় লেগেছিল।
নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা প্রদেশের বিচ্ছন্ন হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার উদাহরণও স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু। তারপর তিনি একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা আপাতত বন্ধ রেখে পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়াকে বিশ্বাস করতেন না। তারপরও আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক অচলাবস্থার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু একটি খারাপ পরিণতির জন্য উভয় পক্ষই প্রস্তুত ছিল।
এদিকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) সভাপতি মওলানা ভাসানী পল্টনে এক বিরাট সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দাবির প্রতি সমর্থন জানান। ভাসানী দাবিগুলো মেনে নিতে ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বানও জানান।
মওলানা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি ‘সার্বভৌম, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের’ দাবি জানান। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানকে ‘আচ্ছালামু আলাইকুম’ বলেছিলেন বলে সমাবেশে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের স্মরণ করিয়ে দেন। এসময় তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ন্যাপ গঠন করেন। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম মওলানা ভাসানীকে ‘রেড’ বলে প্রায়ই আখ্যায়িত করতো।
‘বেলুচিস্তানের কসাই’ বলে পরিচিত পাকিস্তানের নতুন প্রতিনিধি লে. জেনারেল টিক্কা খান কয়েকদিন আগে ৬ মার্চ ঢাকায় আসেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল আহসানের স্থলাভিষিক্ত হন। তখন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান।
টিক্কা খান প্রথম বাধার সম্মুখীন হন গভর্নর হিসেবে তার শপথ গ্রহণের ব্যাপারে। কেউ তাকে শপথ পড়াতে রাজি হননি।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী তাকে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ তাকে শপথ পড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের সব বিচারপতিই তাকে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান। এটি আবারও প্রমাণ করলো যে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মান্য করছিল।