‘লোকজন ভাবে, আমি বুঝি খ্রিস্টান। আমার পুরো নাম শোনার পর তাঁদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়,’ হাসতে হাসতে বলছিলেন ভারতের ৬০০ নারী বৈমানিকের মধ্যে এখন পর্যন্ত একমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী, বেঙ্গালুরুর মেয়ে সারাহ হামিদ আহমেদ।
বিষয়টি দারুণ উপভোগও করেন পঁচিশ বছর বয়সী সারাহ। তিনি বলে, ‘আমি একজন মুসলিম, এটা জানার পর লোকজনের যা চেহারা হয়, সে দেখার মতো।’ খবর হিন্দুস্তান টাইমস।
তাঁর পেশার নাম শুনে লোকজনের চমকে যাওয়াটা বরাবরই সারাহ হামিদের কাছে ‘ব্যাপক বিনোদন’। একটা পুঁচকে মেয়ে হয়ে নিজের তুলনায় কয়েক গুণ বিশাল সাইজের যন্ত্রপাতি তিনি সামাল দেন কী করে, অনেকের কাছেই তা বিস্ময়, বলতে বলতেই আবার হাসিতে ফেটে পড়েন সারাহ।
নিজের দুই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সারাহ বলেন, ‘বেচারারা জানে না, ওড়ার জন্য আমার আঙুলগুলোই যথেষ্ট।’
তবে সবার প্রতিক্রিয়া সব সময় ঠিক সুখকর হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলার পর বিশ্বজুড়ে ইসলাম-বিদ্বেষের আঁচটা সারাহও বেশ ভালোই টের পেয়েছেন। কিন্তু সব সামলেছেন নিজের রসবোধ ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার দিয়ে।
তবে সারাহকে প্রথমেই লড়তে হয়েছে নিজের পরিবার ও সমাজের সঙ্গে। তিনি জানান, যারা মনে করে মেয়েদের একমাত্র কাজ হলো বিয়ে করে সন্তান জন্ম দেওয়া, তাদের টিপ্পনী এখনো তাঁকে শুনতে হয়।
‘প্রথমে আমরা ওকে নিরুৎসাহিত করেছিলাম। আমাদের এখানে মেয়েরা সাধারণত পরিবার ছেড়ে একা দূরে থাকতে হবে, এমন কোনো পেশায় যায় না’, স্বীকার করেন সারাহর বাবা, পেশায় আলোকচিত্রী হামিদ হুসেইন আহমেদ। কিন্তু যখন বুঝলেন, মেয়ে তাঁর মোটেই দমার পাত্রী নয়, তখন হামিদ যোগাযোগ করেন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর বৈমানিক বন্ধু আতিফ ফরিদের সঙ্গে।
‘ফরিদ বলল, মেয়ের সিদ্ধান্তে আমার নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করা উচিত। কেননা, বেশির ভাগ মুসলিম মেয়েই বিমান চালানোর কথা স্বপ্নেও ভাবে না। ফরিদ আমাকে আশ্বস্ত না করলে মেয়ের স্বপ্নটাকে কবর দেওয়ার মতো ভুল করে বসতাম।’
সালটা ২০০৭; সারাহ তখন সবে আঠারো। ভর্তি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমান চালনা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে।
‘সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে ইচ্ছুক মুসলমান শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগকেই ভিসা দেওয়া হতো না। যখন কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই ও ভিসা পেয়ে গেল, মনে হলো আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা জানিয়ে দিয়েছেন’, বলছিলেন সারাহর ধর্মভীরু বাবা।
সারাহর মা নাসিমা আহমেদ বলেন, মেয়েকে আমেরিকা পাঠাতে কখনোই তাঁর আপত্তি ছিল না। তাঁর সবচেয়ে গর্ব হয়েছিল সেদিন, যখন এক বিয়েবাড়িতে সারাহকে ঘিরে একদল মেয়ে জানতে চাইছিল, কীভাবে বৈমানিক হতে হয়।
সারাহ আরো স্বপ্নও দেখেন, ‘আমি বিয়ে করতে চাই, মা হতে চাই।’
কিন্তু মনের মতো পাত্র খুঁজে পাওয়াটা ভীষণ মুশকিল, বললেন সারাহ।
‘আমি বুঝি না, কীভাবে শুধু আমার ছবি দেখেই কেউ আমাকে তাঁর ছেলের বউ করতে চাইতে পারেন। তাঁরা কি জানতে চান না, আমি কি পড়াশোনা করেছি কিংবা কোথায় চাকরি করি?’
সারাহর পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন অথবা অন্য শহরে বদলি হতে বলেন।
‘এমন প্রস্তাব কেউ দিলে বাবা রীতিমতো তেড়ে যান। বলেন, আপনাদের ছেলেকে বলুন না, চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানে বদলি হতে’, আরেক দফা হাসির ফোয়ারা ছোটান সারাহ।
নারী দিবসে তাঁর মতো মুসলিম নারীদের উদ্দেশে সারাহ বলেন, ‘সমাজ তোমাকে কী বলল, তা নিয়ে ভেব না। তাদের হাতে তোমার স্বপ্নের মৃত্যু হতে দিও না।’
নারী দিবসেও বিমান নিয়ে আকাশে উড়েছেন স্পাইসজেট এয়ারলাইন্সে চাকরি করা সারাহ হামিদ আহমেদ।