অর্থ ও বাণিজ্যে

পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ

শীর্ষ ৫ অর্থনীতির দেশের একটি হবে আগামীর বাংলাদেশ

স্বাধীন বাংলা এখন ৪৪ বছরের পরিণত এক দেশ। অর্থ, বাণিজ্য, সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় অনেকের কাছেই অনুকরণীয় এক নাম বাংলাদেশ।

অর্থ-বাণিজ্যে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ‘৭১ পূর্বে পরাধীনতার শৃঙ্খলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এদেশের কোনো ব্যবসা বা ব্যবসায়ীকে দাড়াতে সুযোগ দেয়নি। ‘৪৭ পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের সব সম্পদ লুট করে নিজেদের অধীনে রাখতে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। যার ফলে পিছিয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা সম্ভামনাময় এই বাংলাদেশ।

ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে কেনা এ দেশ আজ অর্থনীতিতে মধ্যম আয়ের এক দেশের পথে। অন্যদিকে পরাজিত শক্তি হানাদার পাকিস্তান আজ আত্মঘাতী বোমা হামলা, জঙ্গি ও তালেবানের হামলায় বিপর্যস্ত এক অর্থনীতির পথে।

স্বাধীনতার পর থেকেই অগ্রগতি আর উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। কয়েক দশক আগে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে এগিয়ে থাকা পাকিস্তানকে অনেক ক্ষেত্রেই পেছনে ফেলে দিয়েছে বর্তমান বাংলাদেশ।

আর এতে জারপরনায়তায় বিস্মিত পাকিস্তান সরকার। যার প্রমাণ মিলেছে গত বছরে ১৬-১৭ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘পঞ্চম সার্ক বিজনেস লিডারস কনক্লেভ’ এ। সেখানে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রগতির বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খুররাম দস্তগির খান।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। তাদের রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমাদের রপ্তানি আয় অনেক বেশি। ওদের চেয়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্বিগুণ। কেবল তাই নয়, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন সূচকেও বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলছে। পাকিস্তানের বিস্মিত বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের এই অগ্রগতির রহস্য জানতে চেয়েছেন।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের হিসাব মতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় স্বাধীনতার পরে প্রথমবারের মতো ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিভিন্ন পণ্য বিদেশে বিক্রি করে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয় করেছে ৩০ দশমিক ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১০-১১ অর্থ বছরে রপ্তানির আয় ছিল ২০.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১১-১২ অর্থবছরে হয়েছিল ২২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।

এদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি রপ্তানি আয় এসেছে ২০.৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২.৫৬ শতাংশ বেশি। এই সময়ের পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমান মাত্র ২৭ হাজার ৭৪৭ মিলিয়ন ডলার।

কেবল রপ্তানি বাণিজ্যই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আমদানি-নির্ভরতা অনেকটাই কমিয়েছে, যতটা পারেনি পাকিস্তান। শিল্পের কাঁচামালের যোগানদাতা ও আমদানি-বিকল্প শিল্প কারখানা বিকশিত হওয়ায় শিল্প খাতে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় কমছে।

আবার খাদ্য উৎপাদন পাকিস্তান আমলের ৯৬ হাজার মেট্রিকটন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি মেট্রিকটনে, যদিও জমির পরিমান কমেছে বহুগুন। বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চাল রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। তাই রপ্তানি আয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের আমদানির পরিমাণও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকারের তথ্য মতে- বাংলাদেশের আমদানির পরিমান ২৮২ বিলিয়ন টাকা, পাকিস্তানের আমদানির পরিমান ৩ লাখ ৩৯ হাজার ১২৩ মিলিয়ন রুপি।

খাদ্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, সরকারি ভাণ্ডারে বর্তমানে ১১ লাখ ২৩ হাজার ২২৬ মেট্রিক টন চালের মজুদ রয়েছে, যা গত বছরের থেকে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৮৩৭ মেট্রিকটন বেশি। বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ও সরকারি গুদামে মজুদ পর্যালোচনা করে খাদ্য অধিদপ্তর ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ মেট্রিক টন চাল ৪২৫ থেকে ৪৩০ মার্কিন ডলার মূল্যে রপ্তানি করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে।

রিজার্ভের দিক থেকে চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে রিজার্ভের পরিমান ২২.৭৭ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ খরচ করে ৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অন্যদিকে পাকিস্তানের রিজার্ভ হচ্ছে (জানুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত) ৯.৮১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

রেমিটেন্সের দিক থেকে বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরের (জুলাই-জানুয়ারি) সাত মাসে আয় করেছে ৮.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনামূলক অবস্থান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের জিডিপির পরিমান ১৩০ বিলিয়ন মার্কন ডলার, পাকিস্তানের ২৩৭ বিলিয়ন মার্কন ডলার। আকারের দিক থেকে পাকিস্তানের জিডিপি বড় হলেও গ্রোথের দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে।

বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ ৬.১২ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানের ৪.১৪ শাতাংশ। এছাড়াও জিডিপি কিউওকিউ (কোয়ার্টার ওভার কোয়ার্টার) হিসেবেও পাকিস্তান পিছিয়ে আছে। এ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি কোয়ার্টারলিতে জিডিপি গ্রোথ আছে ৬.০১ শাতাংশ অন্যদিকে পাকিস্তানের ৪.১৪ শাতাংশ।

এছাড়া পাকিস্তানে বেকারত্বের হার বাংলাদেশের চাইতে অনেক বেশি। বর্তমানে পাকিস্তানে বেকারত্বের হার শতকরা ৬ শতাংশের ওপরে। অন্যদিকে বাংলাদেশে এর হার মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ।

বাংলাদেশে চলতি (২০১৪-১৫) অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ হাজার ২৮৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ হাজার ২২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার (দুই গুণেরও) বেশি।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৯ জানুয়ারি এ সাত মাসে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অর্থ ধার করেনি। উল্টো বিভিন্ন সময়ে নেয়া ঋণের ৯ হাজার ২২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। একই সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার মাত্র ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে সরকারের নিট ঋণ ঋণাত্মক ধারায় নেমে এসেছে। যার পরিমাণ ৬ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের একই সময় এ নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে ডিসেম্বর’১৪ কোয়ার্টারলি হিসেবে পাকিস্তান অভ্যান্তরীণ ঋণের পরিমান দেখা গেছে ৬৪ হাজার ৩৩৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যন্য গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে, মাথাপিছু জাতীয় আয় (মার্কিন ডলারে) ১৯৭২ সালে ৮১.৯১ ডলার, ২০০৬ সালে ৫২০, ২০০৯ সালে ৭৫১ এবং ২০১৪-১৫ সালে ১১৯০ ডলার। কোটি টাকার হিসেবে বাজেটের আকার ১৯৭২-৭৩ সালে ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, ০৫-০৬ সালে ৬১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা, ২০০৮-০৯ সালে ৯৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। প্রত্যাশিত গড় আয়ু বছর হিসেবে ১৯৭২ সালে ৪৬.৮৮ বছর, ২০০৬ সালে ৬৪.৫ বছর, ২০০৯ সালে ৬৬.৮ বছর এবং ২০১৩-১৪ বছরে ৭০.৬৫ বছর। মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লাখ হিসেবে ২০০১ সালে ৩২২ জন এবং মে-২০১৪ সালে এর হার দাঁড়িয়েছে ১৪৩ জনে। শিুশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে জাতিসংঘের ২০১৩ সালের জরিপে ৩৩ জন। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ২০০৬ সালে ৯০.৯ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৯৩.৯ শতাংশ, মার্চ-২০১৫ সালে এসে এর হার দাঁড়িয়েছে ৯৯.৪৭ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৬ সালে ৪ হাজার ৫৮৩ মেগাওয়াট, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ এবং ২০১৪-১৫ সালে ১৩ হাজার ২৮৩ মেগাওয়াট।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনীতির তুলনামুলক চিত্র তুলে ধরে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি বা দুর্যোগ কবলিত দেশ নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেক শক্তিশালী। জিডিপি গ্রোথ, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট অফ ব্যালেন্স, মাথাপিছু আয়, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। সোস্যাল সেক্টরে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালে বাংলাদেশ বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বর্তমান সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর অনেকে মন্তব্য করেছিল- বাংলাদেশ নাকি একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। আমরা তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছি। বিশ্বে আজ বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেল ধরা হয়। কেউ কেউ বলছে, আগামীতে অর্থনৈতিভাবে শীর্ষ ১১টি উন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ থাকবে। আবার কেউ বলছে, ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হবে অন্যতম।” সূত্র- নিউজবাংলাদেশ, বাংলাদেশ ব্যাংক।


অগ্রযাত্রা বিভাগের আরো খবর...
সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুতে  হাইকোর্ট থেকে সমাধান আসা উচিত: প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুতে হাইকোর্ট থেকে সমাধান আসা উচিত: প্রধানমন্ত্রী
আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি পেল বাংলাদেশ আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি পেল বাংলাদেশ
ভেঙে দেওয়া হচ্ছে সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম ভেঙে দেওয়া হচ্ছে সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম
গণতন্ত্র আছে বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র আছে বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পথচলা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পথচলা
আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলুন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলুন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
কোরবানির সুস্থ পশু চেনার উপায়, অসুস্থ গরু থেকে সাবধান কোরবানির সুস্থ পশু চেনার উপায়, অসুস্থ গরু থেকে সাবধান
এইডসের গুজবে বিব্রত মমতাজ এইডসের গুজবে বিব্রত মমতাজ
জুনেই ঢাকায় আসতে পারেন নরেন্দ্র মোদি জুনেই ঢাকায় আসতে পারেন নরেন্দ্র মোদি

পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ
(সংবাদটি ভালো লাগলে কিংবা গুরুত্ত্বপূর্ণ মনে হলে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।)
tweet