রাজশাহীতে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে প্রশিক্ষণার্থী বৈমানিক তামান্না রহমানের মৃত্যুর জন্য বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিকে দায়ী করছে তার পরিবার।
তামান্না এই প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা বলতেন বলে তার বাবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান দাবি করেছেন।
তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ফ্লাইং ক্লাবটির কর্মকর্তারা তাদের নিহত প্রশিক্ষণার্থীর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেছেন, এটি ছিল নিছকই দুর্ঘটনা।
বুধবার রাজশাহীতে উড্ডয়নের সময় আগুন ধরে বিধ্বস্ত হয় তামান্নার বিমানটি। এতে তামান্না মারা যান, আহত হন প্রশিক্ষক।
বৃহস্পতিবার পৈত্রিক নিবাস রাজধানীর নিকুঞ্জ-২ জানাজার পর গাজীপুরের জয়দেবপুরে নানা বাড়িতে দাফন করা হয় তামান্নাকে।
ঢাকায় ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুলে ‘এ’ লেভেল শেষ করা তামান্না বাংলাদেশ ফ্লাইং অ্যাকাডেমির পারসোনাল পাইলট লাইসেন্স কোর্সে (পিপিএল) ভর্তি হন দুই বছর আগে।
এই কোর্স শেষ করতে একজন বৈমানিককে নিজে ৫০ ঘণ্টা বিমান চালাতে হয়। এর অংশ হিসাবেই প্রশিক্ষককে পাশে নিয়ে সেসনা ডি-১৫২ উড়োজাহাজটিতে উঠেছিলেন এই তরুণী।
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ১৭ ঘণ্টা ওড়ার পর মঙ্গলবার এককভাবে বিমান চালানোর অনুমতি পেয়েছিলেন তিনি। তার পরদিনই তার মৃত্যু হল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে তামান্নাদের নিকুঞ্জের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, বাবা আনিসুর রহমান কফিন ধরে কাঁদছেন, পাশে বসে থাকা মা রেহানা রহমান অনেকটাই নির্বাক হয়ে আছেন।
আনিসুর রহমান বলেন, “এটা দুর্ঘটনা নয়, তারা আমার মেয়েকে হত্যা করেছে।
“আমার মেয়ে বলেছিল, এই একাডেমির কোনো কিছুই ঠিক নেই। এরা যদি আপ টু ডেট না থাকে তারা কিভাবে একাডেমি চালায়।”
রেহানা বলেন, “ও বার বার বলত- ইনস্ট্রাকটররা ভালো নয়, প্লেনগুলো ভালো নয়।”
ছোট বোনের ছবি বুকে জড়িয়ে তামান্নার ভাই বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান তার বাবাকে বলছিলেন, “ও বারবার বলতো, একাডেমির কোনো কিছুই নিয়ম মেনে হচ্ছে না। তার পরেও তোমরা ওকে কেন পাঠালে?”
ফ্লাইং ক্লাবগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে অনিয়ম পাওয়া গেলে তা বন্ধ করে দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেন তামান্নার বাবা।
তামান্নার পরিবারের এসব অভিযোগ নাকচ করেন বাংলাদেশ ফ্লাইং অ্যাকাডেমি অ্যান্ড জেনারেল অ্যাভিয়েশন লিমিটেডের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “তার পরিবারের প্রতি আমাদের সকল ধরনের সমবেদনা আছে। তবে এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল, এ ধরনের দুর্ঘটনা কারোরই কাম্য নয়।”
নিরাপত্তার দিকটিতে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়ে সাহাবুদ্দিন বলেন, “মেইটেনেন্স ভালো না হলে ওই উড়োজাহাজটিকে ফ্লাই করতে দেওয়া হত না।”
বিধ্বস্ত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, উড়োজাহাজটি ৫০০ থেকে ৬০০ ফুট উপরে ওঠার পর ইঞ্জিন ‘ফেইলিয়র’ দেখা যায়। বৈমানিক দুজন এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে এটি একদিকে কাত হয়ে ডানার ওপর ভেঙে পড়ে, এতে উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায়।
“ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হলে দুই বৈমানিক ইমার্জেন্সি এস্কেপের চেষ্টা করেন। এ সময় বিমানটি বিস্ফোরিত হয় এবং প্রশিক্ষণার্থী তরুণী বিমানের ভেতরেই দগ্ধ হন।”
দুর্ঘটনার আগের দিন তামান্নাসহ তিনজন নারী শিক্ষার্থীর সফলভাবে ‘সলো ফ্লাইট’ চালানোর তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা তাদের অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। তাদের এ সাফল্যে একটি কনগ্রাটুলেশনস পার্টিরও আয়োজন করা হয়েছিল।”
এই দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশনস) এস এম নাজমুল আনামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা কিছু আলামত সংগ্রহ এবং বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নেন।
কমিটির সদস্য এইচএম আক্তার খান সাংবাদিকদের বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটি, না পাইলটের ভুলে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে, তা খতিয়ে দেখছেন তারা। রোববার একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন তারা জমা দেবেন।
তিনি বলেন, “ওড়ার পরপরই বাঁক নেওয়ার সময় পাইলট বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল কি না, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।” সূত্র : বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর প্রতিবেদন।