তিন দফা অপেক্ষমান থাকার অবশেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় হতে যাচ্ছে বুধবার (২৯ অক্টোবর), যার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উসকানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করবেন। অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এটিই প্রথম রায় দেবেন। নিজামীকে অবশ্যই হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে গত ২৪ জুন নিজামীর যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হলেও ওই দিন সকালে তিনি কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাজির করেননি কারা কর্তৃপক্ষ। ফলে সেদিন রায় ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল।
গত ২৪ মার্চ মামলাটির যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
মামলার ধারাবাহিক সব কার্যক্রম
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে ৩৩৬ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থা। আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়।
তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এতে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি অভিযোগ আনা হয়।
২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
ওই বছরের ২৮ মে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনকালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ১৫টির সঙ্গে ১৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যা যোগ হয়েছে।
নিজামীর বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে গত বছরের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানসহ ২৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে ৭ম সাক্ষী প্রদীপ কুমার দেবকে বৈরি ঘোষণা করে তাকে জেরা করেছেন প্রসিকিউশন।
ঘটনার অন্য ২২ সাক্ষী হচ্ছেন, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিজবাউর রহমান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধকালে বিচ্ছু বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গেরিলা যোদ্ধা জহির উদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী (নিরাপত্তারক্ষী) রোস্তম আলী মোল্লা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, মুক্তিযোদ্ধা নাজিব উদ্দিন খাত্তাব, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান, মো. আইনুল হক, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফিজিশিয়ান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. রথীন্দ্রনাথ কুণ্ডু, শহীদ বুদ্ধিজীবী চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলিম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য মো. আব্দুস সেলিম লতিফ ও তার ছোট ভাই আমিনুল ইসলাম ডাবলু, জানে আলম জানু, মুক্তিযোদ্ধা মো. জামাল উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক, আবু সামা ফকির, শহীদের পুত্র ও মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ তহুরুল আলম মোল্লা, মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী বিশ্বাস, শহীদ পরিবারের সদস্য শাহজাহান আলী এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক।
জব্দ তালিকার ২ সাক্ষী হচ্ছেন বাংলা একাডেমির সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাবউদ্দিন মিয়া এবং জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের কিপার স্বপন কুমার বিশ্বাস।
আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।
অন্যদিকে নিজামীর পক্ষে গত বছরের ২১ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হচ্ছেন, অ্যাডভোকেট কে এম হামিদুর রহমান, মো. শামসুল আলম, আবদুস সালাম মুকুল এবং নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার মো. নাজিবুর রহমান ওরফে নাজিব মোমেন। তাদেরকে জেরা করেছেন প্রসিকিউশন।
তিন দফা অপেক্ষমান রায়
নিজামীর মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রমের শেষ ধাপ সম্পন্ন হওয়ায় তিন দফায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমান রাখা হয়েছে। এছাড়া গত ২৪ জুন নিজামীর যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হলেও ওই দিন সকালে তিনি কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায় ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল।
উভয়পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও জেরা শেষে গত বছরের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর ও ২০ নভেম্বর ৫ কার্যদিবসে প্রথমবারের মতো নিজামীর বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, মোহাম্মদ আলী, হায়দার আলী ও মীর ইকবাল। এরপর ৭ নভেম্বর থেকে চার দিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের জন্য দিন রাখা হলেও নিজামীর আইনজীবীরা আসেননি। ফলে ১৩ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সমাপ্ত বলে ঘোষণা দিয়ে রায় যেকোনো দিন দেওয়া হবে বলে মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের লিখিত যুক্তিতর্ক জমা দিতে বলা হয়।
এরপর ১৪ নভেম্বর আসামিপক্ষ ট্রাইব্যুনালের আদেশ পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ চাইলে ১৭ নভেম্বর থেকে ফের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৭ থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ কার্যদিবসে নিজামীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।
২০ নভেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে নিজামীর মামলার রায় দ্বিতীয়বারের মতো অপেক্ষমান (সিএভি) রেখেছিলেন বিদায়ী চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু রায় দেওয়ার আগেই গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর তিনি অবসরে চলে যান। এরপর থেকে প্রায় দুইমাস ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন না হওয়ায় নিজামীর মামলাসহ পাঁচটি মামলার কার্যক্রম শুধুমাত্র তারিখ পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
৫৪ দিন চেয়ারম্যানের পদ শূন্য থাকার পর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পাওয়া নতুন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন। সেদিনই নতুন করে যুক্তিতর্ক শোনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১০ মার্চ প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১০ থেকে ১২ মার্চ এবং ২৩ ও ২৪ মার্চ নিজামীর বিরুদ্ধে ৫ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, মোহাম্মদ আলী ও সৈয়দ হায়দার আলী। অন্যদিকে গত ১৩ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫ কার্যদিবসে নিজামীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ও মিজানুল ইসলাম।
এর মধ্য দিয়ে ২৪ মার্চ মামলার সর্বশেষ ধাপ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সম্পন্ন হওয়ায় যেকোনো দিন রায় দেওয়া হবে বলে জানান ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের আশা সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড
প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬ অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫টি অভিযোগে গণহত্যা, ৪টি বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে উস্কানি ও বাকিগুলো অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
তিনি আর বলেন, নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আমরা ১৫টি অভিযোগের ওপর অভিযোগভিত্তিক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছি। ৫নং অভিযোগে আমরা কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ দেইনি। বাকি ১৫টি অভিযোগ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। আমরা প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছি।
১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৫টি অভিযোগ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন দাবি করে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, কোনো একটি অভিযোগও যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ (২) ধারা অনুসারে তাকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। আমরা আশা করি, বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণের ভিত্তিতে নিজামীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড প্রদান করবেন।
নিজামীর আইনজীবীর আশা খালাস
নিজামীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন, প্রসিকিউশন নিজামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেননি। নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের পক্ষে প্রসিকিউশন কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি।
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা মিথ্যা এবং শেখানো সাক্ষ্য দিয়েছেন। নিজামীর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণে প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছেন দাবি করে মিজানুল ইসলাম বলেন, আমরা আশা করি, নিজামী সাহেব সকল অভিযোগ থেকে খালাস পেয়ে ন্যায়বিচার পাবেন
নিজামীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) ধারায় মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উসকানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৪(১) ও ৪(২) ধারায় আনা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ।
প্রথম অভিযোগঃ পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতেন। একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে হত্যা করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগঃ একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা।
তৃতীয় অভিযোগঃ একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন।
চতুর্থ অভিযোগঃ পাবনার করমজা গ্রামে নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করা হয়। ৮ মে নিজামীর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী করমজা গ্রাম ঘিরে ফেলে ৯ জনকে হত্যা করে। রাজাকার বাহিনী একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
পঞ্চম অভিযোগঃ একাত্তরের ১৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ২১ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। এ সময় বাড়ি-ঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ষষ্ঠ অভিযোগঃ নিজামীর নির্দেশে ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে অভিযান চালায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।
সপ্তম অভিযোগঃ ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে নিজামীর তথ্যমতে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে সোহরাব আলীকে আটক করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে হত্যা করে।
অষ্টম অভিযোগঃ ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে সেখানে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন।
নবম অভিযোগঃ নিজামীর তথ্যমতে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে ৭০ জনকে হত্যা ও ৭২টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
দশম অভিযোগঃ পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডু প্রাণ বাঁচাতে ভারতে চলে যান। নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা তার বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।
একাদশ অভিযোগঃ একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।
দ্বাদশ অভিযোগঃ ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে শত্রুরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। তিনি পাকিস্তানের শত্রুদের সমূলে নির্মূল করার আহ্বান জানান।
ত্রয়োদশ অভিযোগঃ ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় নিজামী বলেন, হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে রাজাকার, আলবদররা প্রস্তুত।
চৌরশ অভিযোগঃ ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে এক সুধী সমাবেশে নিজামী প্রত্যেক রাজাকারকে ইমানদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আল্লাহর পথে কেউ কখনো হত্যা করে, কেউ মারা যায়। এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ছাত্রসংঘের সদস্য, রাজাকার ও অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উসকানি ও প্ররোচনা দেন নিজামী।
পঞ্চদশ অভিযোগঃ একাত্তরের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী প্রায়ই ওই ক্যাম্পে গিয়ে রাজাকার সামাদ মিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।
ষোড়শ অভিযোগঃ একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তত্কালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।
রায় নম্বর ১০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃতে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। নিযামীর বুধবারের রায় হতে যাচ্ছে ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধ মামলার দশম রায়।
১ম রায়ঃ ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি।
২য় রায়ঃ ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।
৩য় রায়ঃ ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে গতবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
৪র্থ রায়ঃ গতবছর ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষের আপিল শুনানি শেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে আপিল বিভাগ।
৫ম রায়ঃ পঞ্চম রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গতবছর ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী গোলাম আযম।
৬ষ্ঠ রায়ঃ গতবছর ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের ষষ্ঠ রায়।
৭ম রায়ঃ এরপর ১ অক্টোবর সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে। তারাও রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।
৮ম রায়ঃ গতবছর ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত। যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গত ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি।
৯ম রায়ঃ আর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে গতবছর ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক।