ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও বুড়িগঙ্গা

- আপেল মাহমুদ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘ভারী কাজের বোঝাই তরী কালের পারাবারে

পাড়ি দিতে গিয়ে কখন ডোবে আপন ভারে।

তার চেয়ে মোর এই ক-খানা হালকা কথার গান

হয়তো ভেসে বইবে স্রোতে তাই করে যাই দান।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতার এই চারটি চরণ লিখেছিলেন বুড়িগঙ্গায় বসে। তাঁর দ্বিতীয়বারের ঢাকা সফরকালে, একজনের অনুরোধে।

জীবদ্দশায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ ও ১৯২৬ সালে ঢাকায় আসেন। প্রথমবার তিনি এসেছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের দশম অধিবেশনে যোগদান করতে। এই সফরকালে ঢাকা ক্রাউন থিয়েটার হলে ৩০ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত মোট তিন দিন অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি অংশ নেন সম্মেলনে। বিশ্বকবির এই আগমন নিয়ে খুব একটা মাতামাতির খবর জানা যায় না। তবে তাঁর দ্বিতীয়বারের ঢাকা আগমন নিয়ে শুধু যে মাতামাতিই হয়েছে তা-ই নয়, ঢাকাবাসীর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তিনি কোথায় থাকবেন, কী খাবেন-এসব বিষয় নিয়ে শুরু হয়ে যায় দলাদলি। ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসার পর কারো বাসায় না উঠে বুড়িগঙ্গা নদীতে রাখা নৌযানে অবস্থান নেন। রমনা সবুজ চত্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বাংলো থাকার পরও কবিগুরু কেন নদীর মধ্যে নির্জন পরিবেশকে বেছে নিয়েছিলেন এমন প্রশ্ন আজকাল অনেকেই করে থাকেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন গবেষক নানা মত দিয়েছেন। তবে অধিকাংশের মতে, মূলত ঢাকাবাসীর দলাদলির হাত থেকে রক্ষা পেতে রবীন্দ্রনাথ নিজে থেকেই বুড়িগঙ্গার নৌযান বেছে নেন।

গোপালচন্দ্র রায়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালের ৭ জানুয়ারি কলকাতা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে স্টিমারযোগে নারায়ণগঞ্জ এবং মোটর শোভাযাত্রা করে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তাঁর সফরসূচি ছিল ৯ দিনের। রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় আনার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (পরে উপাচার্য হন) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বিশেষ অবদান ছিল। তাই তিনি চেয়েছিলেন, কবিগুরু তাঁর বাসায়ই অবস্থান করবেন। কিন্তু ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা তা মেনে নিতে চাননি। তাঁদের মতে, রবীন্দ্রনাথ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহমান নন, সারা ঢাকাবাসীর মেহমান। রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজ ঘাটে বাঁধা ঢাকার নবাবদের রাজকীয় জলযান তুরাগ হাউস বোটে গিয়ে ওঠেন।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে আমি প্রথম দেখেছিলাম বুড়িগঙ্গার ওপর নোঙর ফেলা একটি স্টিমলঞ্চে। সেখানে নিমন্ত্রণকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রেষারেষি করে ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকেরা তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। উপরের ডেকে ইজি চেয়ারে বসে আছেন তিনি। ঠিক তাঁর ফটোগ্রাফগুলোর মতোই জোব্বা-পাজামা পরনে। আর কেউ কেউ উপস্থিত। রেলিং-এ হেলান দিয়ে আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি।’

১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় লেখা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের রমনার বাসায় রবীন্দ্রনাথকে অতিথিরূপে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ঢাকার নাগরিক এবং বিশ্বভারতীর সদস্যরা শহরের ভেতরে রাখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তা নিয়ে রবীন্দ্র অভ্যর্থনা সমিতির সদস্যদের মধ্যে খুবই বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। শেষে স্থির হয়, রবীন্দ্রনাথের অভিরুচি অনুযায়ীই তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হবে। পরবর্তীতে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী বুড়িগঙ্গায় ভাসমান তুরাগ হাউস বোটেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়।’

বুড়িগঙ্গায় বেশ আয়েশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বসবাস করেছিলেন। সেখানে তিনি অনেককে সাক্ষাৎও দিয়েছিলেন। সেখানে ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশিষ্ট মহিলারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ঢাকার বিপ্লবীদের কয়েকজন সদস্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এসব বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রাম করতেন। রবীন্দ্রনাথের নিরাপত্তা কমিটির প্রধান ছিলেন সত্য গুপ্ত। তিনি পরে সুভাষ চন্দ্র বসুর সহযাত্রী হিসেবে মেজর সত্য গুপ্ত হিসেবে খ্যাতিমান হন।

একই দিন বুড়িগঙ্গায় কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুখরঞ্জন রায়। তিনি স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন, ‘কবি থাকতেন বজরায়। বুড়িগঙ্গার বক্ষে বজরার ওপর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। ডা. মজুমদার, ডা. ঘোষ, ব্যারিস্টার আর কে দাশ প্রভৃতি ঢাকার গণ্যমান্যদের অনেকে উপস্থিত ছিলেন সেখানে। কবির বয়স সম্বন্ধে আলাপ হচ্ছিল। তাঁর বয়স তখন বোধ হয় চৌষট্টি ছিল। ডা. মজুমদার আমার পরিচয় করে দেন।’

তখন ইডেন কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক কবির সঙ্গে দেখা করতে তুরাগ হাউস বোটে যান। ঢাকা সফরসূচিতে ইডেন কলেজে গিয়ে চা-চক্রে কবিগুরুর যোগদানের বিবরণ রয়েছে। তবে অসুস্থতার কারণে তিনি সেখানে যেতে পারেননি। এ কারণে তাঁরা ১৪ ফেব্রুয়ারি বুড়িগঙ্গায় অবস্থানরত কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করতে যান।

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, কবিগুরুর আগমন উপলক্ষে বুড়িগঙ্গার তীর ও তুরাগ হাউস বোটকে সুসজ্জিত করা হয়। তিনি ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে বুড়িগঙ্গায় ভাসমান জলযানটিতে এসে ওঠেন। এখানে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে তিনি বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী নর্থব্রুক হলে (লালকুঠি) উপস্থিত হন। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি, জজ-ব্যারিস্টার, ডেপুটি-মুন্সেফ, উকিল-মোক্তার, জমিদার-তালুকদার, অধ্যাপক-শিক্ষক সেখানে উপস্থিত হয়ে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জানান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ সালে প্রথম ঢাকায় আসার পরও বুড়িগঙ্গায় এসেছিলেন। এ কারণে বুড়িগঙ্গা সম্পর্কে কবিগুরুর একটা সম্যক ধারণা ছিল। প্রথমবারের সফর ছিল মাত্র তিন দিনের। দ্বিতীয় দিন বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলের জমিদারদের সৌজন্যে বুড়িগঙ্গায় বিশাল এক স্টিমার পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হয়ে ভাগ্যকুলের ধনাঢ্য জমিদারদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন।

দ্বিতীয়বার ঢাকা এসে কবিগুরু যখন বুড়িগঙ্গায় বসবাস করছিলেন তখন নদী ভ্রমণের একটি ঘটনার কথা গোপালচন্দ্র রায়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। তুরাগ হাউস বোটে বাস করার সময় কবিগুরু প্রায় প্রতিদিন সকালে ঢাকার নবাবদের একটি মোটর বোটে করে জল-ভ্রমণ করতেন। ওই সময় চালক ছাড়া আর কেউ তাঁর সঙ্গে থাকতেন না। সঙ্গী বলতে থাকত কয়েকটি বই এবং কিছু কাগজপত্র। তিনি মোটর বোটে করে পাঁচ থেকে সাত মাইল দূর অবধি চলে যেতেন।

বুড়িগঙ্গায় ভ্রমণের কথা তুরাগ হাউস বোটের স্বেচ্ছাসেবক স্নিগ্ধকুমার গুহের বিবরণেও জানা যায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষে কবিগুরু বুড়িগঙ্গায় জল-ভ্রমণে বেরোনোর সময় তিনি কবিগুরুর লেখা ‘বলাকা’ বইটি দিয়ে সেখানে তাঁর একটি কবিতা লিখে দেওয়ার অনুরোধ করলে কবি বইটি হাতে নিয়ে বললেন-বইটি পড়ে নিও। ঘণ্টাখানেক কবিগুরু জল-ভ্রমণ করে এসে তার হাতে বইটি ফেরত দেন। স্নিগ্ধকুমার গুহ বইটি খুলে দেখেন, তাতে লেখা রয়েছে কবির স্বাক্ষর করা ওই চার লাইনের কবিতাটি।

প্রসঙ্গত, মাঝে আর মাত্র ছয় দিন। এরপরই আসছে ২২ শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। ১৯৪১ সালের এই দিনে তিনি পরলোকগমন করেন। প্রতিবছরই গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করা হয়। এবারও ব্যতিক্রম নয়। ২২ শ্রাবণকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কবিগুরুকে স্মরণ করতে নানা অনুষ্ঠান। এর অংশ হিসেবেই কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে এই নিবন্ধ। সূত্র: কালের কণ্ঠ


ইতিহাস বিভাগের আরো খবর...
সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুতে  হাইকোর্ট থেকে সমাধান আসা উচিত: প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুতে হাইকোর্ট থেকে সমাধান আসা উচিত: প্রধানমন্ত্রী
আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি পেল বাংলাদেশ আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি পেল বাংলাদেশ
ভেঙে দেওয়া হচ্ছে সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম ভেঙে দেওয়া হচ্ছে সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম
‘বাঙালীরা মুজিবের ওপর বিশ্বাস রাখেন’ ‘বাঙালীরা মুজিবের ওপর বিশ্বাস রাখেন’
গণতন্ত্র আছে বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র আছে বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পথচলা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পথচলা
আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলুন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলুন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
কোরবানির সুস্থ পশু চেনার উপায়, অসুস্থ গরু থেকে সাবধান কোরবানির সুস্থ পশু চেনার উপায়, অসুস্থ গরু থেকে সাবধান
এইডসের গুজবে বিব্রত মমতাজ এইডসের গুজবে বিব্রত মমতাজ

ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও বুড়িগঙ্গা
(সংবাদটি ভালো লাগলে কিংবা গুরুত্ত্বপূর্ণ মনে হলে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।)
tweet