বাঙালি জাতির জাগরণ, জাতীয় চেতনার বিকাশ, হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির জন্য গণজোয়ার, অকুতোভয় সংগ্রাম, জয় বাংলা স্লোগান, নৌকা প্রতীকে ভোটদান ও মহান স্বাধীনতা; এই সবকিছুর মূলেই রয়েছে একটি নাম- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, বাঙালির প্রাণ, স্বাধীনতার প্রাণভোমরা। বাঙালি জাতির প্রবাদ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশজুড়ে গণমানুষের দলে পরিণত হয় এটি। ৭৫ বছর বয়সের পরিণত এই দলটির হাত ধরে আজ বিশ্বের বুকে বিস্ময় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বাঙালি জাতি।
২৩ জুন, কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী (মুসলিম) লীগ। শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে এই সংগঠনের প্রাতিষ্ঠাতা যুগ্মসাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২৭ জুন তিনি আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে জেল থেকে বের হন। পুরোদমে মন দেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রসারে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এই সংগঠনের সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক হলেও, দেশজুড়ে কর্মী সংগ্রহ ও দলীয় প্রচারণার কাজ করতে হয় শেখ মুজিবকে।
বাংলা ভাষার আন্দোলন ও শেখ মুজিবঃ
মাতৃভাষার অধিকারের জন্য দেশজুড়ে যখন গণজাগরণ তুঙ্গে, এমন সময় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের ভাষণে বলেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ফলে উত্তাল হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদী মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। পাকিস্তানি জান্তাদের গুলিতে প্রাণ হারান অনেকে। রঞ্জিত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। এই সময় শেখ মুজিবকে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। তবে হাসপাতালে থাকার সুবাদে তিনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পান। এসময় ছাত্রনেতাদের ডেকে নিয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পরামর্শ দেন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদেরও এ ব্যাপারে অবহিত করেন। তাঁর নির্দেশেই এই সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করা হয় ছাত্রলীগের কাজী গোলাম মাহবুবকে। শেখ মুজিবের তৎপরতা বুঝতে পেরে ১৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে স্থানাস্তরিত করা হয় তাঁকে। এর আগেই, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে কঠোর আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থণ দেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে অনশন শুরু করেন তিনি। তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সরকার। ১৯৫২ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার ফেরেন তিনি। আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক তখনো বন্দি। তাই দলের কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভা ডাকেন শেখ মুজিব। সভায় তাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের জয়জয়কারঃ
১৯৫৪ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় যুক্তফ্রন্ট। বাংলার প্রতিটি প্রান্তে নিরলস প্রচারণা চালাতে থাকেন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। এই প্রাদেশিক নির্বাচনে কট্টর ধর্মীয় প্রচারণা উপেক্ষা করে মানবিক অধিকারের পক্ষে নৌকা মার্কায় ভোট দেয় জনগণ। ফলে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৮টি আসনে জয়লাভ করে এই জোট। আওয়ামী লীগ একাই পায় ১৪৩টি আসন। আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল সরকার গঠন করে যুক্তফ্রন্ট।
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি বাংলার মানুষের গণরায়ের ওপর ভিত্তির করে, ১৯৫৫ সালের ২২-২৩ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটিকে বাদ দেওয়া হয়। দেশের সর্বসাধারণের সবার জন্য এই দলের দুয়ার খুলের দিতে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের উদ্যোগেই এই বাস্তবায়িত হয়।
১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাদেশিক পরিষদের সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এই মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবকে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ ও গ্রামীণ সহায়তাবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু দলের কাজে সময় দেওয়ার জন্য মে মাসের শেষে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। দেশজুড়ে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগেক শক্তিশালী করার কাজে নিমগ্ন হয়ে যান তিনি।
সামরিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের পুনর্জীবনঃ
১৯৫৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করা হয়। ১২ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবকে। দেশে নিষিদ্ধ করা হয় রাজনীতি। কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে আবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর, একক নেতৃত্বে দলকে পুনর্জীবন প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বর্ষীয়ান নেতারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামরিক সরকারের অধীনে এই রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের সাহসী উদ্যোগে ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সব জেলায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ছয় দফার এক দাবি ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবঃ
১৯৬৬ সালের ১৮ ও ১৯ মার্চের কাউন্সিলে শেখ মুজিবকে সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করের আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। দেশজুড়ে গণপ্রচারণা শুরু হয় ছয় দফার পক্ষে। গ্রাম-গ্রামান্তের মানুষ পর্যন্ত সোচ্চার হয়ে ওঠে ছয় দফার পক্ষে। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে পাকিস্তানিরা। তাই বঙ্গবন্ধু যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। মাত্র দেড় মাসে বিভিন্ন জেলায় ৩২টি জনসভা করেন শেখ মুজিব। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেফতার করে দীর্ঘমেয়াদে জেলে রাখা হয়।
মুক্তির পথ তৈরির জন্য নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনঃ
১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আবুল হাসনাত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক এই ছয় দফার পরপরই বাংলার রাজনীতির গতিপথ বদলে যায়। কারণ ছয় দফায় ছয়টি দাবি থাকলেও মূল দাবি আসলে ছিল একটি, আর সেটি হলো বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি। ছয় দফার প্রথম দুই দফায় রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও পরের চার দফায় অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হলেও, এটি আসলে ছিল বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত দাবি। যার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও গণঅভ্যুত্থানঃ
ছয় দফাকে কেন্দ্র করেই স্বাধীনতার স্বপ্নে যখন বিভোর হয়ে ওঠে পুরো জাতি এরকম এক পরিস্থিতিতে, ১৯৬৮ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর নামে দায়ের করা হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য’ নামের একটি মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা)। জেলে থাকা অবস্থাতেই, ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি, নতুন করে এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। অভিযোগে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যরা পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন’। এসময় দেশজুড়ে মানুষ স্লোগান দিতে থাকে ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একসঙ্গে একাকার হয়ে যেতে থাকে বাঙালির মানসপটে। পরবর্তীতে প্রবল জনরোষের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ও স্বঘোষিত ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাকে। এই গণ-আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হয় এবং ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। অন্যদিকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে একচ্ছত্র হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭০-এর নির্বাচন: আওয়ামী লীগের বিজয় ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ধাপঃ
প্রচণ্ড গণদাবির মুখে ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি জান্তারা। সেই নির্বাচনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একচেটিয়াভাবে ভোট দেয় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে। যার ফলে, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংরক্ষিত ৭ আসনসহ ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে সরাসরি ভোটে জিতে পুরো পাকিস্তানের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে সংরক্ষিত ১০ আসনসহ ৩১০টি আসনের মধ্যে সরাসরি ভোটে ২৯৮টি আসন লাভ করে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার একমাত্র আস্থার জায়গা অর্জন করে বাংলার জনগণের কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।
পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র করে জনগণের রায়কে প্রত্যাখান করার পাঁয়তারা করতে থাকে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কৌশলে দেশবাসীকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সেদিনই বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। দেশজুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি অঘোষিত কিন্তু বিকল্প সরকার পরিচালিত হতে শুরু করে বাংলাদেশে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ব্যবহার হতে থাকে বিকল্প সরকার প্রধানের বাসভবন হিসেবে। শুধু সামরিক ছাউনিগুলো ছাড়া বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আর কোথাও পাকিস্তান সরকারের কোনো আদেশ মানা হলো না। সব স্থান থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে উড়ানো হয় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজের নিশান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম পরিষদ।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাঃ
২৫ মার্চের কাল রাতে ঘুমন্তু বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি জান্তারা। ফলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। এর পরপরই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের নির্জন জেলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আপামর বাঙালি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের মুক্তাঙ্গনে শপথ নেন তারা। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ ও উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দায়িত্ব নেন। অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে দিয়ে গঠন করা হয় স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে রণাঙ্গন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্ষাক্ষয়ী যুদ্ধের পর, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে মহান বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন মহাকাব্যের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
জাতীয় চার নীতি ও সোনার বাংলা পুনর্গঠনের অসমাপ্ত যুদ্ধঃ
আওয়ামী লীগের হাত ধরে হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে মহান স্বাধীনতা। জাতির পিতার নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ সম্পদ নিয়ে চলতে থাকে অবকাঠামো নির্মাণ। দীর্ঘমেয়াদে সুন্দর জাতি গড়ার লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয় বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা। এরমধ্যেই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা হয় সংবিধান। জাতীয় ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে “বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে” ঘোষণা করা হয় জাতীয় চার নীতি হিসেবে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে অনেক অভ্যন্তরীণ দুর্বত্তায়ন এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশকে প্রায় গুছিয়ে আনেন তিনি। কিন্তু এরমধ্যেই বাংলার আকাশে নামে দুর্ভোগের ঘনঘাটা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও আওয়ামী লীগের ওপর দমনপীড়নঃ
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, স্বৈরশাসকদের হিংস্র থাবায় বিক্ষত হতে থাকে সোনার বাংলা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। ১৫ আগস্টের কালরাতে বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই দুহিতা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। স্বৈরশাসকরা যখন আওয়ামী লীগ ভেঙে দেওয়ার জন্য নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক তখনই নেতাকর্মীদের আহ্বানে দলের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে দল ও দেশকে বাঁচাতে দেশে ফেরেন তিনি। স্বৈরাচারের বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধী দুর্বৃত্তরা এবার তাঁকেও হত্যার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। সেই থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, প্রতিদিন জীবন হাতে নিয়ে টানা ৯ বছর রাজপথে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এই ৯ বছরের মধ্যে প্রত্যেক বছরেই আটক ও বন্দি করা হয় শেখ হাসিনাকে। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাকে আটক করে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাকে দুবার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের মার্চে তাকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে তাকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবারো গ্রেফতার ও গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৯০ সালে নভেম্বরে শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়।
শেখ হাসিনার হাত ধরে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাঃ
অনেক লড়াই সংগ্রাম শেষে অদম্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন জননেত্রী শেখ হাসিনা। এসময় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চাপ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ। ফলে ফিরে আসে সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগের ওপর দমন-পীড়ন থেমে থাকে না। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তার কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি ছোড়া হয়। তবুও মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে কখনও পিছপা হননি শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে বিএনপির একটি সাজানো নির্বাচনের বিরুদ্ধে তিনি গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হন। এবং জুন মাসে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২১ বছর থমকে থাকার পর আবার চলতে শুরু হয় বাংলাদেশ।
১/১১ এর কালো ছায়া কাটিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অভিযাত্রাঃ
বিএনপি-জামায়াত সরকারের মেয়াদ শেষ। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, নিয়ম অনুযায়ী একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা তাদের। কিন্তু লুটপাট অব্যাহত রাখার জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে খালেদা জিয়ার পরামর্শে, ২৯ অক্টোবর রাতে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন বিএনপি সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ফলে সৃষ্টি হয় সাংবিধানিক সংকট। এসবের প্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, সুশীল সমাজের ছদ্মবেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্য। মাইনাস টু ফর্মুলার নামে দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর অপচেষ্টা শুরু হয়। ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় তাকে। মিথ্যা মামলায় ২০০৭ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে জেলে ঢোকানোর পর, একের পর এক মোট ১৩টি মামলা সাজানো হয় তার নামে। ২৪ জুলাই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। জেলে বন্দি অবস্থায় শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘদিন স্বজনদের সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা হয়। তার চিকিৎসা প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। গ্রেনেড হামলায় আহত কান ও চোখ চিকিৎসার অভাবে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। মানসিকভাবে শক্ত থাকলেও, শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাকে স্লো-পয়জনিং করা হচ্ছে বলেও আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তার অসুস্থতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যায়। অবশেষে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা টানা ২০ দিন চিকিৎসার পর তাকে আপাত স্বাভাবিক করে তোলেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এদিকে বিএনপি-জামায়াত চক্র এবং কতিপয় সামরিক সদস্য নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আটক ও হয়রানি শুরু হয়। ২০০৮ সালের ২৩ মে, আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলের ৭২টি সাংগঠনিক শাখার তৃণমূল নেতারা শেখ হাসিনার প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন এবং তাকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য দেশজুড়ে চলমান আন্দোলন জোরদার করার ঘোষণা দেন। ২৭ ও ২৮ মে, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় সিদ্ধান্ত হয়- শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের এই ঘোষণার পর দেশজুড়ে শুরু হয় গণগ্রেফতার। প্রায় ২০ হাজার মানুষকে জেলে ঢুকানো হয়। কিন্ত তবুও শেখ হাসিনার পক্ষে গণজোয়ার থামানো যায়নি। অবশেষে জননেত্রীর জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের সামনে কুচক্রীদের সব রকমের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ১১ জুন, বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা। জেল থেকে বের হয়ে, গণমানুষের ভাগ্য বদলের জন্য ‘দিন বদলের সনদ’ ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও দুঃসাহসী নেতৃত্বে ভর করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আয়োজিত জাতীয় নির্বাচনে একচেটিয়া জয় লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের জোট। জোটের মোট অর্জিত ২৬৭ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগই পায় ২৩০টি।
উন্নত বিশ্বের দিকে ধাবমান প্রিয় সোনার বাংলাঃ
আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই দেশ থেকে দূর হয়েছে ক্ষুধা ও দারিদ্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ও রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে, টানা ৪র্থ বার ও মোট ৫ম বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ এখন উন্নত বিশ্বের তালিকায় নাম লেখানোর স্বপ্নময় পথ অতিক্রম করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্নের গণ্ডি ছড়িয়ে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে দেশের মানুষ। বীরের জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মান ফিরে পেয়েছে বাঙালি জাতি। এক যুগের চলমান সুশাসনে দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার পর গত তিন যুগের অধিক সময়ে যা সম্ভব হয়নি, আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ এক যুগে তাই সম্ভব হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস, দেশ ও মানুষের জন্য নিবেদিত থেকে আত্মদানের ইতিহাস। সুখে-দুঃখে- দুর্যোগে দুর্বিপাকে- সর্বদা গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে- সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাওয়াই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দৃপ্ত প্রত্যয়।