দক্ষিণ ভারতের কেরালার বন্দর শহর কোচি-তে চুম্বন-প্রতিবাদ কর্মসূচি ঠেকাতে পুলিশের পাশাপাশি পথে নেমেছিল কিছু কট্টরপন্থি সংগঠনও। কলকাতায় সেটা হয়নি৷ কোচি আর কলকাতার মধ্যে তফাত বলতে এইটুকুই।
নগর প্রশাসন বরং কিছুটা উদাসীন থাকল গোটা ঘটনার প্রতি। কোনও রক্ষণশীল গোষ্ঠী বাধাও দিতে এল না। পথচলতি মানুষজন কৌতূহল নিয়ে, হয়তো বা কিছুটা কৌতুক নিয়েই ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখলেন এই চুম্বন আন্দোলন।
কিন্তু সমাজের এবং প্রশাসনের নীতিবাগীশ মানসিকতা তাতে আদৌ কতটা অস্বস্তিতে পড়ল, ছাত্র-ছাত্রীদের এই অভিনব প্রতিবাদ রক্ষণশীলতার অচলায়তনে কতটা আঁচড় কাটল, সেই সন্দেহ কিন্তু থেকেই গেল। প্রশ্ন জাগল, যে প্রাপ্তবয়স্ক যুবক এবং যুবতীরা এই আন্দোলনে শামিল হলেন, তাঁরা সবাই সামাজিক লজ্জা, সংকোচ, সংশয় এবং অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে সত্যিই ভাবতে পারলেন তো, যে কথা তাঁরা স্লোগানে বলছিলেন - ‘‘আমার শরীর, আমার মন আমারই সম্পত্তি?”
কিছু প্রতিবাদ উঠেছে এই চুম্বন আন্দোলনের বিরুদ্ধে। সবই আমাদের সমাজের শিখিয়ে দেওয়া নীতিকথা, যা বয়ঃপ্রাপ্তির সময় থেকেই শেখানো হয় আমাদের পরিবারে, স্কুল-কলেজে, যে চুম্বন-আলিঙ্গন ইত্যাদি নিভৃত, গোপন অন্তরঙ্গতার বিষয়। সেটাকে রাস্তায় নামিয়ে আনলে কুকুর-বেড়ালের সঙ্গে মানুষের আর কোনও তফাত থাকে না! অনেকে আবার প্রত্যাশিতভাবেই ভারতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতির কথা তুলেছেন, যেখানে নাকি প্রকাশ্যে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অনুমোদন নেই৷
আবেগতাড়িত মন্তব্য হিসেবে এগুলোকে ধরা যায়, কিন্তু যুক্তি হিসেবে একেবারেই নয়। কারণ কুকুর-বেড়াল, বা অন্য যে কোনও প্রাণীর সঙ্গে মানুষের শরীরসুখের সবথেকে বড় ফারাকটা হল, মানুষের ক্ষেত্রে শুধু আদিম প্রবৃত্তিটাই নয়, তার সঙ্গে সমান সক্রিয় থাকে এক স্পর্শকাতর মন। অবশ্য শুধু মানুষ নয়, বিজ্ঞান বলে, ডলফিন বা শুশুকরা এবং এক শ্রেণির ওরাংওটাং-ও নাকি যৌনতা উপভোগ করে। মনের উপস্থিতি না থাকলে সেটা শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ বা অন্যান্য যৌন অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
অবশ্য প্রশ্নটা এখানে শরীর- সুখ প্রকাশ্যে উপভোগ করা নিয়ে। এমনকি আলিঙ্গন-চুম্বনও যেখানে জৈবিক কামনার বহির্প্রকাশ হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ভারতে যা ঘোর নিন্দনীয় বলে মনে করা হচ্ছে, পশ্চিমের দেশগুলোতে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক এক আচরণ। তা হলে কে ঠিক করে দেবে তা হলে, কোনটা ঠিক আর কোনটা নয়!
এখানেই প্রশ্ন উঠছে দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতির। কিন্তু সেই যুক্তিও যথেষ্টই দুর্বল। কারণ, শরীর বা যৌনতা যদি ভারতীয় সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের পরিপন্থি হতো, তা হলে কোনারক বা খাজুরাহোর মন্দির তৈরি হতো না, লেখা হতো না কামসূত্র। বরং ইতিহাসকেই যদি মানতে হয়, তা হলে ভারতে প্রথমে ইসলামি শাসনের প্রভাব, পরে ব্রিটিশ শাসনের যে ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতা, তার প্রভাবে শরীর সম্পর্কে এক ধরণের ছুৎমার্গ তৈরি হয়েছে বলে ধারণা হয়।
আজকের সমাজ এবং প্রশাসনও কিন্তু এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, কোনটা অনৈতিক, অশ্লীলতাই বা কী, সে সবই স্থির হয়ে আছে ওই মানসিকতা থেকে। চুম্বন-প্রতিবাদ আসলে সেই বন্ধ দরজায় একটা ধাক্কা। বিরুদ্ধমতের লোকদের ডেকে বলা যে, আসুন, এগুলো নিয়ে কথা বলি। আমার বান্ধবী, স্ত্রী, এমনকি সঙ্গিনীকেও যদি হঠাৎ আমার আদর করতে ইচ্ছে হয়, তা হলে নির্জন আড়াল খোঁজার থেকে ওই মুহূর্তের অনুভূতির তাৎক্ষণিক বহির্প্রকাশই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। আমি যেমন আপনার নিভৃত অন্তরঙ্গতাকে সম্মান করছি, আপনিও আমার স্বতস্ফূর্ততাকে স্বীকার করুন।
কিন্তু আমরাও কি আসলে সেটা ভেতর থেকে বিশ্বাস করছি? কলকাতার চুম্বন প্রতিবাদে দেখা গেল, দুজন পুরুষ পরস্পরকে চুম্বন করছে, যারা কিন্তু সমকামী নয়! অথবা দুজন মহিলা পরস্পরকে চুম্বন করলেন৷ সাহসের অভাবে অনেক ছাত্র-ছাত্রী গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে প্রতিবাদের দায় সারলেন! না, তাদের যে চুম্বনে উন্মত্ত হয়ে জনতাকে দৃশ্যসুখ দিতে হবে, এমন কথা কেউ বলছে না। কিন্তু কোথাও কি তাঁরা নিজেদের অন্তর্গত রক্ষণশীলতায় আটকে গেলেন? কোথাও কি তাঁদের মনে হলো যে, যে সমাজকে তাঁরা কার্যত চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন, সেই সমাজের বিধিনিষেধগুলো অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তাঁরা এখনও অর্জন করেননি?
তা হলে বাকি সমাজের কাছে বার্তাটা কী পৌঁছল?