ডেস্ক রিপোর্ট: চলছে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা লাগাতার অবরোধ। এর মধ্যেই টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুক্রবার বাদ ফজর ভারতের মাওলানা ইসমাইল হোসেন গোদরারের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ইসমাইল হোসেনের বয়ানের তরজমা (বাংলায়) শোনান বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান। জুমার নামাজের আগ পর্যন্ত চলে এই বয়ান।
ইজতেমার প্রথম পর্বের মতই সীমাহীন ভোগান্তি এবং জীবনের ঝুঁকির মধ্যে দ্বিতীয় পর্বে আসা মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে শরিক হচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকেই ময়দানে ঈমান, আমল ও আখলাকসহ তাবলিগের ছয় উসুল সম্পর্কে অনানুষ্ঠানিক বয়ান শুরু হয়। আগামী রোববার ১৮ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এ বছরের বিশ্ব ইজতেমার।
এর আগে অবরধের ভেতরই ৯ জানুয়ারি শুরু হয় ইজতেমার প্রথম পর্ব, যা ১১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। চার দিন বিরতির পর আজ দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে।
এবারের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে দেশের ৩৪ জেলার মুসল্লিরা যোগ দিচ্ছেন। এর জন্য ময়দানকে ৩৯ খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ওই সব জেলার লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে পৌঁছে গেছেন এবং মুসল্লিদের আসা আজও অব্যাহত আছে। পাশাপাশি ভারত, পাকিস্থানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসল্লিরাও ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন। বিদেশি মুসলমানদের জন্য বরাবরের মতো ময়দানের উত্তর পশ্চিম পাশে তৈরি করা হয়েছে বিদেশি নিবাস।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধের মধ্যে তাবলিগ জামাতের মুসল্লিরা ট্রেন, মিনিবাস, বাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যানসহ ছোট ছোট যানবাহনে করে দীর্ঘ পথ হেঁটে ইজতেমা ময়দানে আসেন। অনেক সময় সরাসরি বাস আসতে না পারায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসতে হয় মুসল্লিদের। সেই সঙ্গে বাড়তি ভগান্তি হিসাবে যোগ হয় বৃহস্পতিবারের হরতাল, মুসল্লিদের ভোগান্তি চরম হয় এতে।
হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির কারণে দিনের চেয়ে রাতে অধিক মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে আসছেন।
ইজতেমার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ইজতেমার দ্বিতীয় দফায় অংশ নিতে ইতিমধ্যেই লাখো মুসল্লি সেখানে সমবেত হয়েছেন। বিভিন্ন জেলার কিশোর, যুবক, বয়োজ্যেষ্ঠ সব শ্রেণির মানুষ ইজতেমায় এসেছেন। অনেকে দীর্ঘ ৪০ বা ১২০ দিন ইসলামের দাওয়াত শেষ করে ইজতেমায় শরিক হচ্ছেন। আবার কেউ ইজতেমা শেষে দেশ-বিদেশ ঘুরে ইসলামের দাওয়াত দিতে ৪০ বা ১২০ দিনের জন্য বেরিয়ে পড়বেন। ধনী, দরিদ্র সবাই এখানে এক শামিয়ানার নিচে একসঙ্গে অবস্থান করছেন।
সরকারি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় অংশ নিতে সৌদি আরব, পাকিস্তান, ভারত থেকে শুরু করে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার ৮৮ দেশের ৪ হাজার ৩ শ’ জন বিদেশি মেহমান ইজতেমা ময়দানে এসে পৌঁছেছেন। মুসল্লিদের ইজতেমামুখি এ ঢল অব্যাহত থাকবে আখেরী মোনাজাতের আগ পযর্ন্ত।
দ্বিতীয় পর্বে ৩৪ জেলা
দ্বিতীয় পর্বে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের ৩৪ জেলার মুসল্লিরা অংশ নিচ্ছেন। এর জন্য ময়দানকে ৩৯ খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। জেলা ও খিত্তাগুলো হচ্ছে- ১ ও ২ নং খিত্তায় নারায়ণগঞ্জ জেলা, ৩ ও ৪ নং খিত্তায় ঢাকা, ৫ নং খিত্তায় কক্সবাজার, ৬ নং খিত্তায় মানিকগঞ্জ, ৭ নং খিত্তায় পিরোজপুর, ৮নং খিত্তায় পটুয়াখালী, ৯/১ ও ৯/২ নং খিত্তায় টাঙ্গাইল, ১০/১ ও১০/২ নং খিত্তায় জামালপুর, ১১ নং খিত্তায় বরিশাল, ১২ নং খিত্তায় নেত্রকোনা, ১৩ নং খিত্তায় কুমিল্লা, ১৪ নং খিত্তায় মেহেরপুর, ১৫ ঝিনাইদহ, ১৬, ১৭ ও ১৮ নং খিত্তায় ময়মনসিংহ, ১৯ নং খিত্তায় লক্ষ্মীপুর, ২০ নং খিত্তায় বি-বাড়িয়া, ২১ নং খিত্তায় কুড়িগ্রাম, ২২ নং খিত্তায় বগুড়া, ২৩ নং খিত্তায় পঞ্চগড়, ২৪ নং খিত্তায় চাপাইনবাবগঞ্জ, ২৫নং খিত্তায় নীলফামারী, ২৬নং খিত্তায় নোয়াখালী, ২৭ নং খিত্তায় ঠাকুরগাঁও, ২৮ নং খিত্তায় পাবনা, ২৯নং খিত্তায় নওগাঁ, ৩০ ও ৩১ নং খিত্তায় মুন্সিগঞ্জ, ৩২নং খিত্তায় মাদারীপুর, ৩৩ নং খিত্তায় গোপালগঞ্জ,৩৪ নং খিত্তায় সাতক্ষীরা, ৩৫ নং খিত্তায় মাগুরা, ৩৬নং খিত্তায় কুষ্টিয়া, ৩৭নং খিত্তায় সুনামগঞ্জ, ৩৮নং খিত্তায় খুলনা ও ৩৯নং খিত্তায় মৌলভীবাজার জেলা।
ইজতেমার জিম্মাদার গিয়াস উদ্দিন জানান, দ্বিতীয় পর্বের তিন দিনের কর্মসূচিতে থাকছে আম ও খাসবয়ান, তালিম, দরছে কোরআন, দরছে হাদিস, কার গুজারি, নতুন জামাত তৈরি ও যৌতুকবিহীন বিয়ে।
জুমার নামাজ
দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমার প্রথম দিন শুক্রবার হওয়ায় কয়েক লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের নিয়ে দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় এই ইজতেমা ময়দানে, যা ময়দান ছাড়িয়ে বিস্তৃতি লাভ করে আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায়। লাখো মুসল্লির এই জামাতের ইমামতি করেন, ঢাকা কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়ের।
জুমার নামাজে ঢাকা, গাজীপুর ও টঙ্গীর আশপাশের এলাকার অগণিত মুসল্লি অংশ নেন।
তুরাগ পাড়ে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে লাখো মুসল্লির উপস্থিতিতে জুমার নামাজ শেষে আবার শুরু হয়েছে বিভিন্ন ভাষায় বয়ান। বয়ানে ইসলামী চিন্তাবিদরা ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যক্রম
এবারের দুইপর্বের ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের প্রথম দফার নেয়া বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মোঃ আনিসুর রহমান দুই পর্বের ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সম্পর্কে গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম সাংবাদিকদের অবহিত করেন। তিনি জানান, “টঙ্গী ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক কার্যক্রম মনিটর ও যোগাযোগের জন্য একটি কন্ট্রোল রুম সার্বক্ষণিক খোলা থাকছে। ইজতেমা মাঠে প্রবেশের বিভিন্ন গেইট, বিশেষ করে হোন্ডা গেইট, বাটা গেইট, মন্নু গেইটসহ টঙ্গী হাসপাতালে অস্থায়ী মেডিক্যাল সেন্টার স্থাপন করা হবে। এছাড়া সিভিল সার্জন ঢাকা বিভাগ কর্তৃক বিশ্ব ইজতেমা মাঠের পশ্চিম দিকে দুইটি মেডিক্যাল সেন্টার স্থাপন করা হবে। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে তিন শিফট চালু রাখার জন্য প্রতি শিফটে প্রতি সেন্টারে ২ জন ডাক্তার, ২ নং ফার্মাসিস্ট এবং ১ জন সহায়ক কর্মচারী দায়িত্ব পালন করবেন। মেডিক্যাল সেন্টারগুলোর প্রত্যেকটির সাথে একটি করে অ্যাম্বুলেন্স থাকবে।”
তিনি আর জানান, “টঙ্গী হাসপাতালে ১০টি এ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ডবাই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টঙ্গী হাসপাতালে একটি হৃদরোগ ইউনিট দৈনিক দুই শিফটে এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হতে আগত বার্ন ইউনিট সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া অ্যাজমা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকাস্থ জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল হতে আগত একটি ইউনিট টঙ্গী হাসপাতালে চিকিতসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসাপাতাল ও পুনবার্সন প্রতিষ্ঠান হতে আগত একটি মেডিক্যাল টিমও দায়িত্ব পালন করছে। ৫০ শয্যা হাসপাতাল টঙ্গীতে সার্জারি ইউনিট জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করছে। মেডিক্যাল ইউনিটের মাধ্যমে নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইজতেমা চলাকালীন টঙ্গী হাসপাতালে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে ও আর টি কর্ণার চালু রাখা হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারসহ হাসপাতালের প্যাথলজি, এক্সরে ও দন্ত বিভাগ প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করছে এবং অন্তঃবিভাগে ভর্তিকৃত রোগিগণকে কনসালটেন্সী সেবা, ঔষধপত্র, পথ্য ও নার্সিং সেবা দেয়া হচ্ছে।”
নিরাপত্তা
এবারও ইজতেমার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ১২ হাজার পুলিশ ও র্যাবসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এ পর্বেও থাকছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ পিপিএম জানান, বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে নিরাপত্তা ব্যবস্থার গত পর্বের চেয়েও জোরদার করা হয়েছে।এ ছাড়া বিদেশী নিবাসে, জেলা ওয়ারি খিত্তায় খিত্তায় সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন থাকছে। পুলিশ এবং ট্রাফিক বিভাগ যানজট নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। গত পর্বের মতো এ পর্বেও রাস্তায় কোন যানজট থাকবে না।
অপরদিকে, জেলা প্রশাসক মো: নূরুল ইসলাম জানান, বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম দ্বিতীয় পর্বেও সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন জন্য ঢাকা বিভাগীয় প্রশাসনের দিক নির্দেশনায় বিভিন্ন বিভিন্ন বিভাগে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইজতেমা ময়দানে ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার এবং ২৮টি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে ও ২০জন ম্যাজিষ্ট্রেট সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করছেন।
স্পেশাল সার্ভিস
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে দ্বিতীয় পর্বেও বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সংস্থা (বিআরটিসি) বিশেষ ট্রেন ও বাস চলাচলের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
ট্রেন: দ্বিতীয় পর্বে ১৬, ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি মুসল্লিদের জন্য বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ১৬ থেকে ১৮ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত সকল ট্রেন টঙ্গী রেল স্টেশনে ২ মিনিট বিরতি দেবে।
বাস: এছাড়া বিআরটিসিও বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে অন্য বছরে ন্যায় এ বছরেও বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করেছে। রাজধানীর গুলিস্থান, ফুলবাড়িয়া, কমলাপুর, মতিঝিল, ফার্মগেট, গাবতলী, মহাখালী, আজিমপুর থেকে ইজতেমাস্থল পর্যন্ত বিশেষ বাস সার্ভিস চালু থাকবে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নানা পদক্ষেপ
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এবারের দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মজিবুর রহমান কাজল জানান, ইজতেমা উপলক্ষে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কাউন্সিলর, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সমন্বয়ে ১২টি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি ইজতেমা চলাকালে সার্বক্ষণিক ভাবে বিভিন্ন সেবাদান কার্যক্রম বাস্তবায়নে নিয়োজিত থাকবে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ইজতেমাস্থলের প্রবেশ পথে পুলিশের ৫টি ও র্যাবের ৯টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা, কামারপাড়া ব্রীজের নীচে বাঁশের বেড়া ও রাস্তার দুইপাশ এবং কন্ট্রোল রুমের সামেন বালি দিয়ে সলিং করা, অস্থায়ী টয়লেট নির্মান, বর্জ্য নিষ্কাশন, ব্লিচিং পাউডার ও মশার ঔষধ সরবরাহ করে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। এছাড়া ইজতেমা স্থলের পানির সংযোগস্থলে পর্যাপ্ত পানি সংযোগ ও ব্যবস্থাপনা জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া ১২ গভীর নলক’পের মাধ্যমে ইজতেমা ময়দানে প্রতিদিন ৭০ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।