বাংলাদেশে গত এক মাস ধরে যে প্রায় নজিরবিহীন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা চলছে, সেই সঙ্কটে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্ব ঢাকার শেখ হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত বলেই ইঙ্গিত মিলেছে।
বিজেপি-র প্রথম সারির নেতারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার মতো ‘পরীক্ষিত বন্ধু’র পাশ থেকে সরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে একান্ত আলোচনায় তারা এটাও স্বীকার করছেন, বিরোধী বিএনপি-র সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ আছে – কিন্তু সেটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক সম্পর্কর বাইরে কিছু নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা-র সাম্প্রতিক ভারত সফরেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার ওপর ভারত ও আমেরিকা উভয়েই গুরুত্ব আরোপ করেছে বলে তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
ভরসা শেখ হাসিনাতেই
বাংলাদেশে গত বছরের ৫ জানুয়ারির যে বিতর্কিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তি থেকে সে দেশে বর্তমান সঙ্কটের শুরু, সেই নির্বাচনকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করেছিল প্রতিবেশী ভারত। তার কয়েক মাসের মধ্যে খোদ ভারতেই ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে – কিন্তু কংগ্রেসকে হঠিয়ে যারা দিল্লির ক্ষমতায় এসেছে সেই বিজেপি নেতৃত্বও শেখ হাসিনার ওপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে রাজি বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থ নাথ সিং, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন – তিনি সেটা একরকম স্বীকারও করে নিচ্ছেন।
মি সিং বিবিসি-কে বলছিলেন, “ভারতের সম্পর্কটা যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে, তারপরও কোন দল সেখানে ক্ষমতায় সেটাও কিন্তু একটা ফ্যাক্টর। আর সে দিক থেকে বলতেই হবে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থের প্রতি, আমাদের উদ্বেগের প্রতি দারুণ বিবেচনা দেখিয়েছেন। আর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ভারত যে জাতীয় স্বার্থকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেবে, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।”
ফলে শেখ হাসিনার ব্যাপারে ভারতের মোটেই কোনও ধৈর্যচ্যুতি হয়নি বলেই বিজেপি নেতারা বলছেন। বরং তাদের যুক্তি, “গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রাখতে গেলে শেখ হাসিনা-ই কিন্তু আমাদের একমাত্র অপশন – কারণ ভারত মনে করে তিনি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের প্রধান!”
‘শান্তি চাই, তবে হস্তক্ষেপ নয়’
তবে বাংলাদেশের এই মুহুর্তে যে সঙ্কট চলছে, সেটাকে ঠিক ‘নজিরবিহীন’ না মনে-করলেও সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি তাদের কপালেও কিন্তু ধীরে ধীরে ভাঁজ ফেলছে।
বিজেপি-র পক্ষ থেকে তাদের জাতীয় মুখপাত্র এম জে আকবর বাংলাদেশ-সংক্রান্ত অনেক বিষয় দেখাশুনো করেন, সেই মি আকবরও বলছিলেন ভারত চায় সেখানে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হোক – কিন্তু তার জন্য ভারত আদৌ কোনও হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়।
তাঁর কথায়, “আমরা সব সময় চাই আমাদের দেশে ও প্রতিবেশী দেশে শান্তি থাকুক। কিন্তু প্রতিবেশী দেশে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠলেও সেখানে নাক গলানো বা হস্তক্ষেপ করাটা কিন্তু ভারতের নীতি নয়। সেটা ভারত কখনও করেনি, করবেও না।”
শ্রীলঙ্কা, নেপাল বা তিব্বতের ইতিহাসের দিকে তাকালে মি আকবরের এই বক্তব্য মেনে নেওয়া কঠিন ঠিকই – কিন্তু বিজেপি নেতারা দাবি করছেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা পুরোপুরি সত্যি কথা – কারণ বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে ভারত শেখ হাসিনার সমস্যা বাড়াতে চায় না।
তবে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভারতের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের ধারণা – বাংলাদেশে এই মুহুর্তে সামরিক অভ্যুত্থানের কোনও আশঙ্কা নেই, ফলে অভ্যুত্থান হলে তারা শেখ হাসিনা-কে সমর্থন করবেন কি না সে প্রশ্নও অবান্তর।
বিএনপি-র সঙ্গে যোগাযোগ
হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও বিজেপি-র শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা কিন্তু স্বীকার করছেন, সে দেশে পরিস্থিতির দিকে তাদের সতর্ক নজর আছে – এমন কী বিরোধী দল বিএনপি-র সঙ্গেও গত আট মাসে ধীরে ধীরে তাদের একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
বিগত ইউপিএ আমলে বিএনপি-র সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ একরকম থেমেই গিয়েছিল, সেটা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে।
তবে প্রসঙ্গটা এমনই স্পর্শকাতর, যে বিজেপি নেতারা বিএনপি-র সঙ্গে তাদের সম্পর্কর বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও চান না – আবার অস্বীকারও করতে পারছেন না।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপি নেতারা একটা কথাই শুধু জোর দিয়ে বলছেন, বাংলাদেশ সঙ্কটের সমাধান খুঁজতে হবে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই – তার অর্থ যেভাবেই করা হোক না কেন। গণতন্ত্রের বাইরে এই সঙ্কটের অন্য কোনও সমাধান নেই – সেটাও তারা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন।