সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, বইমেলায় আসা লেখক-পাঠকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আগামী বছর থেকে বইমেলাকে আরো সুরক্ষিত করা হবে।
‘বইমেলার সামনে মৌলবাদী ঘাতকচক্র যেভাবে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে তাতে প্রমাণ হয় এ অন্ধকারের অপশক্তি জ্ঞান বা যুক্তি নয় বরং হত্যা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের পথে দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে চায়। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকান্ডের পর দু’দিন গ্রন্থমেলায় যে বিপুল জনসমাগম ঘটেছে তা প্রকৃতপক্ষে এই হত্যাকান্ড এবং দেশে বিরাজমান সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামী বছর থেকে বইমেলার নিরাপত্তা আরো সুরক্ষিত করা হবে,’ বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে আয়োজিত মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি মন্ত্রী আজ একথা বলেন।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে সন্ত্রাসী হামলায় মুক্ত চিন্তার লেখক ড. অভিজিৎ রায় নিহত হন। তার মৃত্যুতে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে অভিজিতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সমাপনী অধিবেশনের শুরুতে এক মিনিট দাাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা হয়।
বাংলা একাডেমির সভাপতি এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আন্যান্যের মধ্যে সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, গ্রন্থমেলা আয়োজন সহযোগী টেলিটক বাংলাদেশ-এর উপ-মহাব্যবস্থাপক শাহ জুলফিকার হায়দার এবং লন্ডনে বাংলা একাডেমি বইমেলা আয়োজনের সংগঠক গোলাম মোস্তফা বক্তৃতা করেন। গ্রন্থমেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫’র সদস্য-সচিব ড. জালাল আহমেদ।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্ত আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতার ও মানবতার শত্রুরা বারবার মাথাচাড়া দিচ্ছে। আমাদের চেতনার মূলে আঘাত হানতে চাইছে। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা আমরা সফল হতে দেব না। তাদের প্রতিহত করতে আমদের অবিরাম যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, বইমেলা আমাদের বাঙালি জাতির প্রাণের আবেগকে ধারণ করে। আমরা আজ পৃথিবীর দীর্ঘতম গ্রন্থমেলার সমাপন ঘটাতে যাচ্ছি। এই দীর্ঘ গ্রন্থ উৎসবের আয়োজন আমাদের জন্য বিপুল গৌরবের। এই গ্রন্থমেলা কেবল বিকিকিনির মেলা নয় বরং চেতনার অভূতপূর্ব মিলনোৎসবও বটে। মেলাকে আমরা বাংলা একাডেমি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের গন্ডি পেরিয়ে একটি ধারাবাহিক কার্যসূচিতে পরিণত করতে চাই। ভবিষ্যতে জেলাভিত্তিক বইমেলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে তৃণমূলের মানুষের কাছে সহজে বই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলেও মন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অভিজিৎ হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ঘাতকেরা বাঙালীর জাতীয় চেতনার ঐতিহ্যবাহী বইমেলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করতে চায়। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশে বসবাসরত মানুষের মুক্ত চিন্তার পথ বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু তাদের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। এসব অপচেষ্টা প্রতিহত করার মধ্যে দিয়ে আমরা যে একটি সভ্য জাতি সেটি প্রমাণ করতে হবে।
ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, গ্রন্থমেলার সময় বৃদ্ধির যে দাবি উঠেছিল তার প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই অমর একুশের চেতনায় গ্রন্থমেলা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর থাকে। এই বৈশিষ্ট্যকে আমরা কোনমতোই লঘু করতে চাইনা।
আজ শনিবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী দিনে মেলায় নতুন বই এসেছে ১২৫টি এবং ১৫টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এনিয়ে এবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫ উপলক্ষে মোট নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৩ হাজার ৭০০টি।
বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ মাসব্যাপি গ্রন্থমেলার প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, পেট্রোল বোমা, সন্ত্রাসের কারণে জনমনে আতংক বিরাজ করছে । তা সত্বেও এবছর গত বছরের বিক্রির চেয়ে ২ কোটি টাকার বেশি বই বিক্রি হয়েছে।
তিনি বলেন, গতকাল ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে। আজকের বিক্রিসহ একাডেমির মোট বিক্রি হবে আনুমানিক ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বাংলা একাডেমিসহ গ্রন্থমেলায় মোট বিক্রির পরিমাণের সঙ্গে আজকের বিক্রির সম্ভাব্য টাকা যুক্ত করলে এই মেলায় সর্বমোট বিক্রয়ের পরিমাণ (বাংলা একাডেমিসহ) ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। গতবছর এই বিক্রির পরিমাণ ছিলো ১৯ কোটি টাকার কিছু বেশি।
অনুষ্ঠানে প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পরিচালিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার ২০১৪ প্রদান করা হয়। কানাডা প্রবাসী কবি ও কথাসাহিত্যিক ইকবাল হাসান এবং লেখক ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ ইকবাল এ পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫০,০০০.০০ টাকার চেক, পুস্পস্তবক, সনদ এবং ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
২০১৪ সালে সর্বাধিক সংখ্যক গুণগত মানসম্পন্ন গ্রন্থ প্রকাশের জন্য মাওলা ব্রাদার্স-কে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’, মুর্তজা বশীরের আমার ‘জীবন ও অন্যান্য গ্রন্থ’ প্রকাশের জন্যে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে এবং রবীন্দ্রসমগ্র খন্ড-২৩ প্রকাশের জন্যে পাঠক সমাবেশ-কে ‘শহিদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালে সর্বাধিক সংখ্যক গুণমানসম্মত শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশের জন্য সময় প্রকাশন-কে ‘রোকনুুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।
২০১৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় প্যাভিলিয়ন ক্যাটাগরিতে দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, স্টল ক্যাটাগরিতে প্রথমা প্রকাশন এবং জ্যার্নিম্যান বুকস্-কে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।
এর আগে বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় নাট্যকার শম্ভুমিত্র শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্প সমালোচক আবুল হাসনাত। নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন হাসান ইমাম, এস.এম. মহসীন এবং শাহাদাৎ হোসেন নিপু।
সমাপনী সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার, শাম্মী আখতার, তপন মাহমুদ, ফেরদৌস আরা, অদিতি মহসিন, সুজিত মোস্তফা প্রমুখ।