আজ ৪ মার্চ। একাত্তরের অগ্নিঝরা আরও একটি দিন। এদিনেই ছাত্র-জনতার সাথে আন্দোলনে যোগ দেন শিল্পীরা। সারাদেশেই নানা শ্রেণী পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন। আন্দোলনে নতুন গতি পায়।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকাসহ সারা বাংলায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।
হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬ জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে দুদিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে।
বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর স্বাধিকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষু বীর সংগ্রামীদের প্রাণরক্ষার্থে শত শত নারী-পুরুষ ও ছাত্রছাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন।
এদিন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে। বেতার-টেলিভিশন শিল্পীরা ঘোষণা করেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন ততদিন পর্যন্ত ‘বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাঁরা অংশ নেবেন না।’
৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ’চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহবানে সাড়া দেয়ায় বীর জাতিকে অভিনন্দন জানায়।’
বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহবান জানিয়ে বলেন, ‘যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পাননি শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।’
এদিন করাচী প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহবান করার দাবি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড. এ ভুট্টো করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘দেশের সংহতির জন্য তাঁর দল যদ্দুর সম্ভব ৬-দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কী না- এ প্রশ্নের জবাবে জনাব ভুট্টো বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে। এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবো।’
আন্দোলনের পাশাপাশি এদিন দফায় দফায় বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা, উদ্দেশ্য ৭ মার্চের জনসভা সফল করা। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) চলতে থাকে জনসভার প্রস্তুতি। পাশাপাশি ঢাকাসহ সারাদেশেই গঠন হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র নেতারা গোপনে নানা স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান চালাতে থাকেন বেশ জোরেশোরেই।