৭ই মার্চের ভাষণের পর দেশ উত্তাল হয়ে পড়ে- প্রতিবাদে, মিছিলে-মিটিং-এ, অসহযোগে, আলোচনায়, নব-উদ্যমে। ৮ মার্চের সকাল থেকে যা স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। ৯ মার্চে যার উত্তাপ সমভাবে পরিলক্ষিত হয়- মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে পড়েছিল এই দিন সারাদেশ। আর একাত্তরের উত্তাল এই দিনেই ঢাকার পল্টন ময়দানে ঐতিহাসিক এক বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “হে বাঙালীরা, আপনারা মুজিবের ওপর বিশ্বাস রাখেন, তাকে খামোকা কেউ অবিশ্বাস করবেন না, কারণ মুজিবকে আমি ভালভাবে চিনি।”ওই জনসভায় বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, “সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো আপোষ সম্ভব নয়, আপোষ চলবে না।”
ওইদিন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ‘পাকিস্তানের জল্লাদ’ খ্যাত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে বলেন, “অনেক হয়েছে আর নয়, তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই।… পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও।”
জনসভায় মওলানা ভাসানী তুমুল করতালির মধ্যে বলেন, “মুজিবের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলব।”
মওলানা ভাসানীর এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে পূর্ণ-আস্থা প্রকাশ পায় ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বামপন্থীদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। এবং পল্টনের জনসভার পর মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে দীর্ঘ টেলিফোন আলাপ করেন।
এদিকে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের বৈঠকে “স্বাধীন বাংলাদেশ” প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। সভায় আন্দোলনে নিহতদের, বিশেষ করে ছাত্রলীগ নেতা ফারুক ইকবালসহ অন্যদের স্মরণে এক শোকপ্রস্তাব গৃহীত হয়।
একাত্তরের এই দিনে ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। যেখানে সেখানে জটলা-সমাবেশ, মিছিল, মিটিং চলতেই থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এমনকি বিভিন্ন স্থানে গোপন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ ও গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতিও চলে বলে একাধিক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে পরে জানা যায়।
৮ মার্চের মতো এই দিনও সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে সারাদেশ ছিল অচল। জরুরী প্রয়োজনে যে সব কার্যালয় খোলা রাখতে বলা হয়েছিল- সেগুলো বাদে সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস-আদালত, সচিবালয়সহ সবই বন্ধ থাকে। (অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের নির্দেশে ব্যাংক-বীমা দফতরসমূহ সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়েছিল।)
এ ছাড়া এই দিনও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ও বাসা-বাড়িতে কালো পতাকা উড়ানো হয়।
মূলত বাংলাদেশের যুবকদের রক্তে তখন একই নেশা, একটিই মন্ত্রবীজ- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” দু’চোখে দেশকে হানাদারমুক্ত করার স্বপ্ন। বাঙালীদের নতুন একটি দেশের স্বপ্ন।
এইদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকাস্থ জাতিসংঘের উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দফতর পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’-এর ছাত্রসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারী করেন। রাজশাহীতে নৈশ কারফিউ জারীর পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারীর কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারী জনসাধারণের জন্য উস্কানী ছাড়া আর কিছু নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
এবং এই দিন সকালে পিআইএ-র বাঙালী কর্মচারীরা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে ধানমণ্ডিস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলে তিনি তাদের সাক্ষাৎদান করেন।
বাঙালীর ইতিহাসে অগ্নিগর্ভ মাস মার্চ। ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম দিন থেকে শুরু করে পুরো মাস ধরে বাঙালীর প্রচণ্ড আবেগ, উত্তেজনা, সংগ্রাম ও রক্তদানের এক মহান ইতিকথা- যা বাঙালীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর