আজ ২৫ মার্চ। বাঙালির ইতিহাসে এ দিবাগত রাত চিহ্নিত বর্বর গণহত্যার স্মারক ‘কালরাত’ হিসেবে। ১৯৭১ সালের এ রাতে নিরপরাধ নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পৈশাচিক হত্যার উল্লাসে। পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। এ গণহত্যা আজও বিশ্ববিবেকের কাছে মানবতার লঙ্ঘন ও বর্বরতার এক ঘৃণ্যতম দৃষ্টান্ত।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এ গণহত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরে। যার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের টানা নয় মাস ধরে। তবে এ নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে অসীম সাহসী বাঙালিও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শত্রুর ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড। সেখান থেকে ভারী ট্যাংক ও সেনাবোঝাই লরিগুলো নল উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। একে একে ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলসহ সব হলেই হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পাননি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। এক রাতে তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রী শহীদ হন। অন্যদিকে নৃশংসভাবে শাহাদাত বরণ করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি নগরজুড়েও রাতভর চলে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংসের তাণ্ডব। এ রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যৰ করেছিল, অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যা। ন’মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে। মাত্র ন’মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই।
কী ঘটেছিল সেই ভয়াল রাতে
সূর্য ডুবল। পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট বিমানে করাচী পাড়ি দিলেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন। কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারাদিন ধরে রোদেপোড়া নগরী চৈত্রের হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। তারপর দু’ঘণ্টাও যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে জীপ, ট্রাকবোঝাই দিয়ে সৈন্য ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা ছক অনুযায়ী পজিশন নিচ্ছে। গোলান্দাজ, সাঁজোয়া পদাতিক তিন বাহিনী থেকে বাছাই তিন ব্যাটালিয়ন ঘাতক। রাত ১০টা ৩৫। নর্থ ঢাকায় সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল বর্তমানে শেরাটন হোটেল ঘিরে ফেলেছে। ডিসিপশনে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন বাচ্চা ক্যাপ্টেন লিখে দিল_ বাইরে বেরুলেই গুলি। বিদেশী সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। না কাফর্র কোন ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে কানপাতা দায়। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। কাঁচা ঘুমে জাগানো বারণ। ঢাকা-করাচী টেলিপ্রিন্টার লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচারও। কেউ জানতেই পারেনি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে মার্কিন ট্যাঙ্ক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানী হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। অসহায় নারী-পুরুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তা-ব। প্রতিটি রুমে রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জল্লাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধার্ত শকুনীরা শুধু হত্যা করেই ৰাস্ত হয়নি; পাকি জানত্মা সেই রাতে বাবার সামনে মেয়েকে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। কাউকে কাউকে তারা সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোঁড়ার কাজ করতে। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তে। তাদের দিয়েই একে একে সহপাঠীদের লাশ টানিয়ে এনে মাটিচাপা দিয়েছিল পাক সেনারা। তারপরও শেষ রৰা হয়নি। কাজ শেষে তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়।
সেদিন রাতে একযোগে জগন্নাথ হল ছাড়াও ইকবাল হল, রোকেয়া হলে শকুনীর দল একে একে দানবের মতো হিংস্র থাবায় তছনছ করে দিয়েছিল। পাক জান্তার কালো থাবা থেকে রৰা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয় শিৰককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য মানুষকে। চারদিক রক্ত আর রক্ত, সারি সারি শহীদের লাশ। সেদিন হিংস্র শ্বাপদ পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ ছাত্রী লাফ দিয়ে পড়েছিল। নরপশুরা সেদিন হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, লুট, জ্বালাও-পোড়াও প্রত্যৰ করেছিল শহরের সব জায়গায়। সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশের সদর দফতরে পাকসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালী পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শত্রম্নর ট্যাঙ্ক আর ভারি মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সমসত্ম ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশের সদর দফতর। সে রাতে ১১শ’ বাঙালী পুলিশের রক্ত ঝরিয়েও তারা ক্লান্ত হয়নি, গুঁড়িয়ে দেয় পুরো ব্যারাক, জ্বালিয়ে দেয় সবকিছু। ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তানি আক্রমণ অত্যাসন্ন, তখন শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকে ঢাকারই শহরতলিতে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন, যাতে ‘শিগগির তারা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন’। তারপর একনাগাড়ে প্রায় ৩৩ ঘণ্টা গোলাগুলির বিরামহীন শব্দে তাজউদ্দীনের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি, যে অনুমানের ভিত্তিতেই তাকে শহরতলিতে অপেক্ষা করতে বলা হয়ে থাকুক, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে দলের কোনো নেতৃস্থানীয় সদস্যের সঙ্গে আলাপ-পরামর্শের সুযোগ তাজউদ্দীনের ছিল না। তা সত্ত্বেও পরবর্তী লক্ষ্য ও পন্থা সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে তাদের কোনো বিলম্ব ঘটেনি :
১. পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই।
২. এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসেবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া। প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সব শেষে পাল্টা আঘাতের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে তাজউদ্দীন ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে হাজির হন ৩০ মার্চের সন্ধ্যায়। বাংলাদেশে তখন বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহী সিপাহিদের পাশে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা। স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ একতাবদ্ধ।
২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরপরই সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ইয়াহিয়া খান চলে গেছে। তখন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় রাস্তায় হালকা প্রতিবন্ধক বসানো শুরু করে, কিন্তু এসব প্রতিবন্ধক পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। যেসব স্বেচ্ছাসেবক রাস্তায় প্রতিবন্ধক স্থাপন করছিল তারাই পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা প্রথম আক্রান্ত হয়। যদিও অপারেশন রাত ১১টায় শুরু হওয়ার কথা, পাকিস্তানি সৈন্যরা সাড়ে ১১টায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয়। কারণ পাকিস্তানি ফিল্ড কমান্ডার চাইছিল যে, বাঙালি সৈন্যরা যাতে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো সুযোগ না পায়। সেনাবাহিনীকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৬ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী আক্রমণ শুরু করার আগেই দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা শহরের সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ১০ম বাঙালি রেজিমেন্টকে সেনানিবাসে সহজেই নিরস্ত্র এবং পরে নিশ্চিহ্ন করা হয়। ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্টকে ঢাকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং শহরের উত্তরাংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর বেলাল এবং লে. কর্নেল জেডএ খানের সঙ্গে নিযুক্ত কমান্ডো বাহিনী অপারেশনের শুরুতে সহজেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরতে সক্ষম হয়। ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর সদর দফতরে অবস্থিত বেশিরভাগ নিরস্ত্র এবং অসংগঠিত ইপিআর সৈন্যকে আক্রমণ করে। সারা রাত যুদ্ধ করার পর পরাজিত ও পরাভূত করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি বাহিনী কোনো বাধা ছাড়াই সহজে মিরপুরে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীকে গ্রেফতার এবং রাষ্ট্রপতি ভবন ও গভর্নর হাউস দখল করে নিতে সক্ষম হয়, কিন্তু অনেকে পালাতে সক্ষম হয় এবং অনেকে মারা পড়ে। ১৮তম ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনিয়মিত বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ চালায়, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাধা প্রদানের চেষ্টাকে পরাভূত করে, ছাত্রনিবাসে অবস্থানরত নিরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা করে, বেশ কিছু অধ্যাপককেও হত্যা করে এবং তারপর ২৬ মার্চ সকালের দিকে হিন্দু এলাকা এবং পুরান ঢাকা আক্রমণের জন্য গমন করে। রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে পরাজিত হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাদের বেশিরভাগ ধরা পড়ে অথবা এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশনের সময় জনগণের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ করে যথেচ্ছভাবে কামান এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। ভোরের মধ্যে শহর দখলে চলে আসে এবং শহরব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। বেঁচে যাওয়া পুলিশ এবং ইপিআর সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়, কেউ কেউ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় চলে যায়।
২৫ মার্চ কালরাতের বেতার কথোপকথন
[টিক্কা খান পাকিস্তানি সৈন্যদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বেতারে তাণ্ডবলীলা পরিচালনা করে। সেই বেতার কথোপকথন কয়েকজন দুঃসাহসী বাঙালি রেকর্ড করেছিলেন। সেখান থেকেই কিছু অংশ :]
কন্ট্রোল : হ্যালো ৯৯-লাইনে থাকো… নতুন কোনো খবর নেই। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনও যুদ্ধ চলছে। ওভার।
থেকে ৭৭ : ৮৮-র কাছ থেকে শেষ খবর… সে বেশ এগোচ্ছে। কিন্তু সেখানে বহু বাড়ি রয়েছে। ফলে তাকে একটা একটা করে ধূলিসাৎ করতে হচ্ছে… ওভার।
প্রতি ৭৭ : তাকে বলো যে, তার বড় ভাইরা (আর্টিলারি বাহিনী) সত্বরই তার কাছে যাবে, সুতরাং বাড়িগুলো ধূলিসাৎ করার জন্য তাদের ব্যবহার করা যাবে। এবারে অন্যদিকে, আমার মনে হয় লিয়াকত ও ইকবাল (লিয়াকত হল ও ইকবাল হল) এখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি কি ঠিক বলছি? ওভার।
থেকে ৭৭ : কাজ শেষ করার রিপোর্ট এখনও পাইনি, তবে এ দুটোর ব্যাপারে তারা খুবই খুশি। ওভার।
থেকে কন্ট্রোল : খুবই খুশির খবর। ওভার।
প্রতি ৭৭ : দ্বিতীয়ত রাস্তার সেই সব বাধা সম্পর্কে ঘোষণা করতেই হবে। রাস্তায় বাধা তৈরি করতে কাউকে দেখা গেলে তাকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হবে। ১নং, ২নং কোনো এলাকায় রোড বল্গক তৈরি করলে সেই এলাকার অধিবাসীদের শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাদের দায়ী করা হবে এবং ধ্বংস করে দেওয়া হবে… ওভার।
প্রতি ৮৮ : তোমাদের ইমাম (কমান্ডিং অফিসার) কি বলেছে যে, তোমরা কাজ শেষ করতে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় নেবে? ওভার।
থেকে ৮৮ : ইমাম এখন ২৬ নম্বরের সঙ্গে। যদি তোমাদের আর কোনো প্রকার সাহায্য লাগে তাহলে তাকে তোমরা জানাতে পার। বাক্সারদের (বাড়ি ধূলিসাৎ করার স্কোয়াড) সম্পর্কে বলছি, তারা তাদের ঘাঁটি থেকে যাত্রা করেছে এবং সকাল হওয়ার আগেই তোমাদের সামনের বাধা ধূলিসাৎ করার কাজে দ্রুত তারা তোমাদের সাহায্য করতে পারবে। ওভার।
যদিও এই হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা, বাঙ্গালী হত্যা পুরো দেশজুড়ে চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল - জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ধরনের ঠান্ডা মাথার হত্যাকান্ডের কথা অস্বীকার করেছে তবে হামিদুর রহমান কমিশনের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক ধরনের শক্তি প্রয়োগ করেছিলো। জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হল গুলোতে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ভিডিওটেপে ধারণ করেন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইন্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর নূর উল্লাহ। পুরো বাংলাদেশেই হিন্দু এলাকাগুলো বিশেষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মধ্যরাতের আগেই, ঢাকা পুরোপুরি জ্বলছিল, বিশেষভাবে পূর্ব দিকের হিন্দু প্রধান এলাকাগুলো। ২রা আগস্ট, ১৯৭১ টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, “হিন্দু,যারা মোট রিফিউজিদের তিন চতুর্থাংশ, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ক্রোধ ও আক্রোশ বহন করছিল”।
গণহত্যার লক্ষ্যবস্তু
· ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল্স বাহিনীর লোক, পুলিশ এবং আধা-সামরিক আনসার মুজাহিদ বাহিনীর লোক।
· হিন্দু সম্প্রদায়। অ্যান্থনি কুমিল্লায় থাকাকালীন সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের মুখে বলতে শুনেছেন: আমরা কেবল হিন্দু পুরুষদের হত্যা করছি, হিন্দু নারী ও শিশুদেরকে ছেড়ে দিচ্ছি। আমরা সৈনিক, নারী শিশুদেরকে হত্যা করার মত কাপুরুষ আমরা নই।
· ছাত্র - কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তরুণদের দল ও কিছু সংখ্যক ছাত্রী। যারা ছিলেন অধিকতর সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন।
· অধ্যাপক ও শিক্ষকদের মত বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। যারা সংগ্রামী বলে সেনাবাহিনী কর্তৃক সর্বদা নিন্দিত হতেন।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে এই গণহত্যা পৃথিবীর বর্বরতার ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন। তথাপি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, এটি ছিল অতি দুর্বল ও মূলত আত্মঘাতী একটি পরিকল্পনা। এই আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের লক্ষ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে অতি স্বল্প সময়ে সেখানে তাদের আনুগত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু ঢাকার ভিতরে নির্বিচার হত্যকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকার বাইরে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয় যার পরিণতি ছিল নিশ্চিত বিদ্রোহ। ২৫/২৬ মার্চের রাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জরগণের উপর আক্রমন চালিয়ে গণহত্যা পরিচালনা করে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই আক্রমণ ছিল পাকিস্তানের জন্য আত্মঘাতী এবং দুর্বল। কারণ পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল গণহত্যার মাধ্যমে বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে আনুগত্য ফিরিয়ে এনে বিদ্রোহের অবসান ঘটানো। কিন্তু ঢাকায় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড এবং বিশেষত রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পীলখানায় ইপিআর সদর দফতরে হামলার পরিণতিস্বরুপ ঢাকার বাইরে বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে।
প্রাথমিক বিদ্রোহসমূহ
সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে তা হল ঢাকার রাজারবাগ, পীলখানা এবং চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের পাইকারীভাবে হত্যা করতে শুরু করেছে। এই খবর পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালিরা মূলত দেশপ্রেমের তাগিদে বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহের পিছনে কোন সংগঠিত রাজনৈতিক বা সামরিক চালিকা শক্তি ছিলনা। অবশ্য বাঙালিরা মার্চের উত্তাল দিনগুলির শেষে স্বাধীনতার জন্য অনেকটাই উন্মুখ হয়ে ছিল। টিক্কা খানের লক্ষ্য ছিল ৭২ ঘন্টার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে তার কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনা। সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণের মাধ্যমেও তিনি তা করতে পারেননি যার কারণ ছিল বাঙালিদের এই বিদ্রোহ। মূলধারা ‘৭১ গ্রন্থের লেখক মঈদুল হাসানের মতে উদ্ভূত বিদ্রোহসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ কারণে ৮ইবি এবং ইপিআর বাহিনীর বিদ্রোহ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণটি এরকম: বিদ্রোহের পরপর স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র এই বিদ্রোহীদের দখলে আসে। এ সময় ২৬ মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮ইবির সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়া এই বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন।
অভিযানের ভিত্তি
১. আওয়ামী লীগের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াকে বিদ্রোহ হিসেবে ধরে নেয়া হবে এবং যারা সামরিক শাসনের বিরোধিতা করবে তাদের শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
২. যেহেতু সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যদের মধ্যেও আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন রয়েছে, তাই এ অভিযান অত্যন্ত চাতুর্য, চমক, ছল ও গতির সাথে সম্পন্ন করতে হবে।
সাফল্যের শর্ত
১. সমগ্র প্রদেশে একই সময়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
২. সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রনেতা এবং শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে যারা চরমপন্থী তাদের গ্রেফতার করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার করতেই হবে।
৩. ঢাকায় অভিযানের ১০০% সাফল্য অর্জন করতেই হবে। এর জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল ও তল্লাশি করতে হবে।
৪. ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্যান্টনমেন্ট আক্রান্ত হলে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপকতর ও স্বাধীনতর ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সকল যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রেডিও, টিভি, টেলিপ্রিন্টার সেবা, বিদেশী কনসুলেটের ট্রান্সমিটার বন্ধ করতে হবে।
৬. পূর্ব পাকিস্তানী সেনাদের নিষ্ক্রিয় করতে হবে, অস্ত্রাগার ও গোলাবারুদের নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষার দায়িত্ব পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের নিতে হবে। একই কথা খাটবে বিমানবাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস [EPR] এর ক্ষেত্রেও।
ছল ও বিস্ময়
১. উচ্চতর পর্যায়ে, রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করা হচ্ছে তিনি যাতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সদিচ্ছা ব্যক্ত করেন, এমনকি শেখ মুজিবকে এ বলেও ধোঁকা দেয়া যেতে পারে যে জনাব ভূট্টোর অমত সত্ত্বেও ২৫শে মার্চ রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিয়ে ঘোষণা দেবেন।
২. কৌশল পর্যায়ে, যেহেতু গোপনীয়তা সর্বোচ্চ গুরুত্বপুর্ণ বিষয়, নিম্নলিখিত প্রাথমিক অভিযানসমূহ ইতোমধ্যে শহরে অবস্থানরত সেনাগণ পরিচালনা করবে:
. মুজিবের বাড়িতে অনুপ্রবেশ করে উপস্থিত সকলকে গ্রেফতার করতে হবে।
. বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ হলগুলি,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াকত হল, ঘেরাও করতে হবে।
. টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বন্ধ করতে হবে।
. যেসব বাড়িতে অস্ত্র রক্ষিত আছে বলে জানা গেছে তা যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করতে হবে।
· টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বন্ধ না করা পর্যন্ত সেনানিবাসে কোন সেনাসক্রিয়তা দেখানো যাবে না।
· অভিযানের রাতে ২২০০ ঘন্টার পর সেনানিবাস থেকে কাউকে বের হতে দেয়া হবে না।
· যে কোন অজুহাতে রাষ্ট্রপতি ভবন, রাজ্যপাল ভবন, জাতীয় সংসদ সদস্যদের হোস্টেল, রেডিও, টিভি ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এলাকায় সৈন্য সমাবেশ জোরদার করতে হবে।
· মুজিবের বাসগৃহে অভিযানের জন্যে বেসামরিক যান ব্যবহার করা যেতে পারে।
২৫-শে মার্চ, ১৯৭১ এর মধ্য রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হত্যার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নৃজাতি নির্মূল করার পরিকল্পনা হাতে নেয়, যা অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। এই আক্রমণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় যা দীর্ঘ নয় মাস দীর্ঘস্থায়িত হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫-শে মার্চের রাতেই ঢাকা শহরের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। কিন্তু তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্কল্পবদ্ধ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পাবনায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫তম পদাতিক বাহিনী স্থানীয়দের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলশ্রুতিতে, তারা রাজশাহীর ব্যাটেলিয়ন সদরদফতর থেকে জনবল ও রসদের যোগান চায়। মেজর রাজা আসলাম পাবনা এসে পৌঁছেন, কিন্তু রাজশাহীর দিকে পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হন। তাদের বিচলন ব্যাহত হয় স্থানীয় বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের ফলে। স্থানীয় বাঙালি বাহিনী অবরোধক স্থাপন করে এবং নাটোরের ধানাইদহে একটি সেতু ধ্বংস করে আক্রমণ প্রতিহত করতে। গোপালপুর রেলফটকে স্থানীয় স্টেশনকর্তা রেলওয়ে বগিসমূহ দিয়ে অবরোধক তৈরি করেন। মার্চের ৩০ তারিখে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওয়ালি ময়না গ্রামের কাছে যাত্রাবিরতি নেয়ার কালে বাঙালি যোদ্ধাদের একটি দল তাদের আক্রমণ করে স্থানীয় সাঁওতালদের সাহায্য নিয়ে। স্থানীয়দের কাছে ময়নার যুদ্ধ নামে পরিচিত এই সংঘর্ষে চল্লিশজন বাঙালি যোদ্ধা নিহত হন। যদি-ও পাকিস্তানিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম ছিল, তদাপি তাদের মনোবলে ছেদ পড়ে। রাতে পাকিস্তানিরা ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত হয়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরবর্তী দিন, তাদের অনেকেই স্থানীয় বাঙালিদের হাতে ধরা পড়ে; অন্যতম ছিল নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা মেজর আসলাম। সেনাদের স্থানীয় বাঙালি বাহিনীর নেতা ও উত্তরবঙ্গ চিনিকলের সাধারণ ব্যবস্থাপক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম এর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সংক্ষিপ্ত বিচারকার্যের পরে লালপুর এসএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী শ্যামলাল আগরওয়ালা জানান, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাত থেকে সৈয়দপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর সৈয়দপুরের বিহারিরা বাঙালি নিধন শুরু করে। মহল্লায়-মহল্লায় ঢুকে নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এ অবস্থায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল শহরের মাড়োয়ারিপট্টির বাসিন্দারা। ২৪ মার্চ থেকে সৈয়দপুর শহরের বাঙালি পরিবারগুলো পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সৈয়দপুরের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে স্থানীয় মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের শীর্ষব্যক্তিত্ব তুলসীরাম আগরওয়ালা, যমুনাপ্রসাদ কেডিয়া, রামেশ্বর লাল আগরওয়ালাকে ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের অদূরে নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। মাড়োয়ারিপট্টিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিহারিরা মাড়োয়ারিদের বাসায় বাসায় চালায় লুটতরাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালীন সকল আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খান এবং রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙ্গালীর স্বাধীনতার দাবী দমন করার প্রয়াসে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে গণহত্যার পরিকল্পনা করে, যা ২৫ মার্চ রাতে বাস্তবায়ন করা হয়।
২৫ মার্চের কালরাত
২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়াকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিলো ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারী মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এই সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্থানী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে।
শিক্ষক হত্যাকাণ্ড
২৫ মার্চের গণহত্যার (অপারেশন সার্চলাইট) প্রথম পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়।
অধ্যাপক ফজলুর রহমান এবং তার দুই আত্মীয় নীলক্ষেতের ২৩ নং ভবনে নিহত হন। তাঁর স্ত্রী দেশের বাইরে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। পাকবাহিনী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা এবং অধ্যাপক রশিদুল হাসানের (ইংরেজি বিভাগ) বাসভবন আক্রমণ করে। তাঁরা দুজনেই খাটের নিচে লুকিয়ে বেঁচে যান, কিন্তু পরবর্তীতে আল-বদর বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। ২৪ নং ভবনে বাংলা সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন। তাঁর বাসভবনে প্রবেশমুখে দুইজন আহত নারী তাদের সন্তানসহ কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের রক্তের দাগ লেগে ছিলো মাটিতে। পাকবাহিনী যখন তাঁর বাসভবন আক্রমণের জন্য আসে, তখন তারা রক্তের দাগ দেখে ধারণা করে নেয় অন্য কোন ইউনিট হয়তো এখানে কাজ সমাধা করে গেছে, তাই তারা আর প্রবেশ করেনি। এভাবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নিতান্ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি জানান যে, ওই ভবনে আরও একজন পূর্ব-পাকিস্থানী অধ্যাপক বাস করতেন, যিনি ২৫ মার্চের আগেই ঘর ছেড়ে যান। অন্যসব বাসায় অবাঙ্গালী কিছু পরিবার থাকতো, যারা অন্যদের কিছু না জানিয়েই ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যায়। ১২ নং ফুলার রোডের বাসভবনে পাকিস্থানী আর্মি সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সায়েদ আলী নোকির বাসায় যায়। আর্মি তাকে ছেড়ে দিলেও ওই একই ভবনের ভূ-তত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মুক্তাদিরকে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ জহরুল হক হলে (তদানীন্তন ইকবাল হল) পাওয়া যায়। পরে তাঁর আত্মীয়েরা তাঁকে পল্টনে সমাহিত করেন। ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ক ম মুনিম, যিনি সেই সময় সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের দায়িত্বে ছিলেন, পাকিস্থানী বাহিনীর আক্রমনে আহত হন। ঢাকা হলের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আ র খান খাদিম ও শরাফত আলীকে হত্যা করা হয়। পাকিস্থানী বাহিনী জগন্নাথ হলে শিক্ষকনিবাসে আক্রমণ করে এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মির্জা হুদা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবিরকে লাঞ্ছিত করে।
তৎকালীন সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের আবাস জগন্নাথ হল আক্রমণের সময় হলের প্রভোস্টের বাসাও আক্রমণ করা হয়। পাকিস্থানী বাহিনী ভূতপূর্ব-প্রভোস্ট এবং জনপ্রিয় শিক্ষক, দর্শণ শাস্ত্রের অধ্যাপক জি সি দেবকে হত্যা করে, সংগে তাঁর মুসলিম দত্তক কন্যার স্বামীকেও। এর পর পাকিস্থানী বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী বাসভবনে আক্রমণ করে এবং সেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড মনিরুজ্জামানকে তাঁর পুত্র ও আত্মীয়সহ হত্যা করে। জগন্নাথ হলে প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। হলের ইলেক্ট্রিসিয়ান চিত্রাবলী ও চাক্ষুস সাক্ষী রাজকুমারী দেবী জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা অধ্যাপক ঠাকুরতাকে চিনতে পারেন এবং তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের কাছে একটি গাছের নিচে সমাহিত করেন। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার সাথে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকেও রাখা হয় এবং পরে হত্যা করা হয়। সহযোগী হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও ছাত্রাবাসেই হত্যা করা হয়। অধ্যাপক আনোয়ার পাশার উপন্যাস “রাইফেল, রোটি, অওরাত” থেকে এ তথ্য জানা যায়। অধ্যাপক পাশা পরবর্তীতে ডিসেম্বর মাসে আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত হন। তিনি তাঁর এই জনপ্রিয় উপন্যাসটি ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন ৯ মাসে রচনা করেন।
ছাত্রহত্যা
অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদ”কে কেন্দ্র করে। তাই, পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিলো এই হলটি। অধ্যাপক ড. ক ম মুনিমের মতে, এই হলের কম-বেশি ২০০ জন ছাত্রকে পাকবাহিনী হত্যা করে। রাত বারোটার পর পাকসেনারা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে এবং প্রথমে মর্টার আক্রমণ চালায়, সেই সাথে চলতে থাকে অবিরাম গুলি। তারা উত্তর ও দক্ষিণের গেট দিয়ে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। সেই আঘাতে ৩৪ জন ছাত্র প্রাণ হারান। জগন্নাথ হলের কয়েকজন ছাত্র রমনা কালী বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। সেখানে ৫/৬ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কেবলমাত্র একজনের নাম পরবর্তীতে জানতে পারা যায়, তার নাম রমণীমোহন ভট্টাচার্য্য। ছাত্রদের কাছে আসা অনেক অতিথিও এই সময় প্রাণ হারান। এদের মধ্যে ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পল, জগন্নাথ হলের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর। ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সেসময় হত্যা করা হয়।
জগন্নাথ হলে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমনে নিহত ছাত্রদের তালিকা
• উপেন্দ্র নাথ রায়: শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান (গ্রাম: গুলিয়ারা, দিনাজপুর)
• কার্তিক শিল : শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর ইংরেজি (কলাখালি, বরিশাল)
• কিশোরী মোহন সরকার : প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর ইংরেজি (পারাগ্রাম, ঢাকা)
• কেশব চন্দ্র হাওলাদার : প্রথম বর্ষ গণিত (কাঁচাবালিয়া, বরিশাল)
• গণপতি হাওলাদার: রসায়ন (ঘটিচরা, বরিশাল)
• জীবন কৃষ্ণ সরকার : শেষ বর্ষ রসায়ন (কুলপাতক, ময়মনসিংহ)
• নণী গোপাল ভৌমিক : দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র (শ্যাম গ্রাম, কুমিল্লা)
• নির্মল কুমার রায় : প্রথম বর্ষ এমকম
• নিরঞ্জন প্রসাদ সাহা : প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান
• নিরঞ্জন হালদার: শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান (শিকড়পুর, বরিশাল)
• প্রদীপ নারায়ন রায় চৌধুরী: প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর ছাত্র।
কর্মকর্তা-কর্মচারী হত্যা
জহরুল হক হল আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাহারারত ইপিআর গার্ডদের হত্যা করা হয়। তারপর হলের কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলী গাজী ও আব্দুল মজিদকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লাউঞ্জে হত্যা করা হয়। রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় আহমেদ আলী, আব্দুল খালেক, নমি, মোঃ সোলায়মান খান, মোঃ নুরুল ইসলাম, মোঃ হাফিজুদ্দিন ও মোঃ চুন্নু মিয়াকে। শহীদ মিনার ও বাংলা অ্যাকাডেমী আক্রমণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাদলটি শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন শিক্ষকনিবাসগুলোয় এবং মধুসূদন দে’র বাসভবনেও আক্রমণ করে। ১১ নং ভবনে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ সাদেককে হত্যা করা হয়। এখানে পাকবাহিনী প্রায় ৫০টির মতো হত্যাকাণ্ড ঘটায়, যাদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ অফিসার (রাজারবাগ পুলিশ লাইনে থেকে পালিয়ে আসা), রাষ্ট্রপতি ভবনের পাহারার দায়িত্বে থাকা ইপিআর সদস্যগণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ২৩ নং আবাসিক ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়া নীলক্ষেত বস্তির কয়েকজন অধিবাসী। মার্চের ২৫ থেকে ২৭ তারিখের মধ্যে পাকিস্থান সেনাবাহিনী ভিন্ন ধর্মালম্বীদের তিনটি উপাসনালয় ধ্বংস করে ফেলে - কলা ভবন সংলগ্ন গুরুদুয়ারা নানক শাহী, রমনা কালী মন্দির ও শহীদ মিনার সংলগ্ন রমনা শিব মন্দির। রাতে দর্শণ বিভাগের কর্মচারী খগেন দে, তার ছেলে মতিলাল দে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সুশীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, ডাক্কুরাম, ভিমরায়, মণিরাম, জহরলাল রাজবর, মনবরণ রায়, রাজবর ও সংকর কুরীকে হত্যা করা হয়।
ছাত্রী-নিবাস আক্রমণ
ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটএর পুর্বপরিকল্পিত গণহত্যার পর ঢাকা শহরের বেঁচে যাওয়া মানুষজন পালানোর স্থান ও প্রথম নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত জিঞ্জিরার দিকে যাত্রা করে। জিঞ্জিরা ও এর আশেপাশের এলাকাগুলো ছিল তখন প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তাই সেগুলো আগে থেকেই পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক চিহ্নিত ছিল। যখন ঢাকা থেকে পালিয়ে সবাই সেখানে জড় হতে থাকে, তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নেয়। তারা ১ এপ্রিল মধ্যরাতের পর থেকে অর্থাৎ ২ এপ্রিল ভোর থেকে জিঞ্জিরায় সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে এবং কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানীরা ঐদিন গভীর রাতেই বুড়িগঙ্গার অন্য পাড়ের মিটফোর্ড হাসপাতাল দখল করে নেয় এবং হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদের ছাদ থেকে আনুমানিক ৫টায় ফ্লেয়ার ছুড়ে গণহত্যা শুরু করার জন্য সংকেত প্রদান করে। প্রায় আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫ টা থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে একটানা নয় ঘণ্টা চালিয়ে যায় এবং দুপুর ২.৩০ এ হত্যাযজ্ঞ শেষ করে। তারা ঘরবাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে পাকিস্তানী বাহিনী ষাট জন লোককে একসাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এ গণহত্যায় আনুমানিক এক হাজার বা তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
পাকিস্তানী প্রচারযন্ত্রের মিথ্যা সংবাদ প্রচার
জিঞ্জিরা গণহত্যার পরের দিন, অর্থাৎ ৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানী প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরা গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং দেশের অন্যান্য মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য হত্যার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এরকম,”Action against miscreants at Jinjira” অর্থাৎ “জিঞ্জিরায় দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন”। আর তৎকালীন পিটিভি (পাকিস্তান টেলিভিশন) ঐ দিন ২ এপ্রিল রাতে খবর প্রচার করে, ” বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুস্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে”।
এরপর প্রতিরোধ শুরু
১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামের এক হত্যাকাণ্ড স্তম্ভিত করে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীকে। ২৫ মার্চ ‘৭১ এর রাতে বাংলাদেশ জুড়ে সংঘটিত হয় তার চেয়েও শতগুণ নৃশংসতা। ভয়াল এ কালরাতের পর স্বজনের লাশ আর ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে জেগে ওঠা বাঙালির আনুষ্ঠানিক প্রতিরোধের পালা শুরু হয় ২৬ মার্চ। গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন-প্রতিরোধের অগ্নস্ফুলিঙ্গ। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর অগণিত বাঙালির আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
আজকের কর্মসূচী
রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ‘কাল রাত্রি’ স্মরণে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিনভর থাকছে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রাতে মোমবাতি প্রজ্বালন। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম রাত ১১টা ৫৮ মিনিট থেকে ১২টা পর্যন্ত (২ মিনিট) সব বাসাবাড়ি, অফিসসহ সবস্থানে সব ধরনের আলো নিভিয়ে নীরবতা পালনের আহ্বান এবং প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে মশাল ও মোমবাতি প্রজ্বালন করে নতুন প্রজন্মের হাতে হস্তান্তর করবে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ৮টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। ৪৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার মশাল জ্বালিয়ে আলোর মিছিলের সূচনা করবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলও পৃথক কর্মসূচি পালন করবে।
তথ্য সূত্র
০১ বাংলা পিডিয়া
০২ উইকিপিডিয়া
০৩ দৈনিক প্রথম আলো
০৪ দৈনিক যুগান্তর
০৫ সামহোয়্যারইন ব্লগ
০৬ আমার ব্লগ
০৭ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট