প্রশিক্ষণ বিমান সেসনা-১৫২ ওড়ার কিছুক্ষণ পর রানওয়েতে ছিটকে পড়ে। ধরে যায় আগুন। এ সময় ‘বাঁচান, বাঁচান’ বলে চিৎকার করছিলেন প্রশিক্ষণার্থী তামান্না রহমান (২২)। ঘটনা দেখার পরও আগুনের তীব্রতায় কাছে ভিড়তে পারেননি দুই ব্যক্তি। চোখের সামনেই আগুনে পুড়ে মারা যান তামান্না।
আহত হয়েছেন বিমানের প্রশিক্ষক পাইলট লে. কর্নেল (অব.) সাঈদ কামাল। মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় তাঁকে বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়েছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত প্রশিক্ষণার্থী তামান্না রহমানের লাশ বুধবার সন্ধ্যায় হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আজ বুধবার দুপুরে রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন পাশের পাইকপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক ডাবলু ও অটোরিকশাচালক লুৎফর রহমান।
শাহ মখদুম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সেতাবুর রহমান জানান, আজ বুধবার দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাঈদ কামাল তামান্না রহমানকে প্রশিক্ষণ দিতে রাজশাহী শাহ মখদুম বিমানবন্দর থেকে একটি প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন করেন। উড্ডয়নের তিন মিনিটের মাথায় ১টা ৫৮ মিনিটের দিকে বিমানটি জরুরিভাবে অবতরণ করতে গিয়ে রানওয়ের পাশে ছিটকে পড়ে যায়। এতে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। বিমানের ভেতর আটকাপড়ে তামান্না রহমান আগুনে পুড়ে মারা যান। পাইলট সাঈদ কামালের শরীরের ৫৫ ভাগের বেশি পুড়ে গেছে।
নিহত তামান্না টাঙ্গাইলের ড. আনিসুর রহমানের মেয়ে। থাকতেন ঢাকার খিলক্ষেত নিকুঞ্জ-২ এর ১২ নম্বর রোডের ২২ নম্বর বাসায়। ড. আনিসুর রহমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক।
২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমী রাজশাহীতে প্রশিক্ষণ নেওয়া তামান্নার আগামী বছরই প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
সিভিল এ্যাভিয়েশনের সিনিয়র সাব-স্টেশন অফিসার ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বিমানটি উড্ডয়নের পর ডান দিকে ঘুরতে গিয়ে বাতাসের কবলে পড়ে। এ সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে বিমানটি রানওয়েতে ছিটকে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়।
“দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সিভিল এ্যাভিয়েশনের গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাজমুল আনামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে হেলিকপ্টারযোগে রাজশাহীতে পৌঁছে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আগামী দুই দিনের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট দাখিল করবে”, জানান এনামুল হক।
এদিকে বিমানবন্দরের পাশের পাইকপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বিমানটি রানওয়ের পাশে ছিটকে পড়ে আগুন ধরলে পাশের পাইকপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক ডাবলু ও অটোরিকশা চালক লুৎফর রহমান বিমানবন্দরের দেয়াল টপকে ভেতরে যান। তবে আগুনের তীব্রতার কারণে তারা প্রথমে বিমানটির কাছে পৌঁছাতে পারেননি। সাঈদ কামাল বিমানের জানালার কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে এসে গায়ে আগুন নিয়ে ‘আমাকে বাঁচান, বাঁচান’ বলে চিৎকার করছিলেন। ডাবলু তাঁকে মাটিতে গড়াগড়ি করার পরামর্শ দেন। তিনি মাটিতে গড়াগড়ি দিলে আগুনের তেজ কিছুটা কমে যায় এবং ডাবলু কামালের শরীরের আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
ডাবলু ও লুৎফর জানান, বিমানের ভেতরে আটক নারী পাইলট ‘বাঁচান, বাঁচান’ বলে চিৎকার করে তাঁদের কাছে ডাকছিলেন। কিন্তু আগুনের কারণে তারা তাঁকে বাঁচাতে পারেননি। বিমানে আগুন ধরার প্রায় ২০ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান বলে জানান ওই দুই ব্যক্তি।
দুর্ঘটনাস্থল ছিল এরকম, ‘আগুনে বিমানটির ককপিট, পাখা, ইঞ্জিন ও মূল কাঠামো পুড়ে আলাদা হয়ে গেছে। বিমানটির সামনের দুই চাকা ছিটকে প্রায় ২০ হাত দূরে পড়ে আছে। বিমানটি যে স্থানে আছড়ে পড়েছে, সেখানে মাটি দেবে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।’
রাজশাহী ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আনসারুল কবির জানান, বিধ্বস্ত হয়ে বিমানে আগুন ধরার খবর তাঁরা বিমানবন্দর থেকে পাননি। টেলিভিশনে বিমান বিধ্বস্তের খবর পেয়ে তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তবে তার আগে বিমাবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট আগুন নিভিয়ে ফেলে।
এর আগেও ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির দুই সিটের একটি সেসনা-১৫২ উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ বিমান রাজশাহী বিমান বন্দরে জরুরি অবতরণ করে। অবতরণের সময় বিমানটি উল্টিয়ে যায়, প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন ফারজানা এবং শিক্ষানবিস বিমান-চালক ডলি উভয়ই সামান্য আহত হয়ে বেঁচে আসেন।