|| মো. শরীফুল ইসলাম মামুন ||
অসম্ভবের অভিযানে এরা চলে
না চলেই ভীরু ভয়ে লুকায় অঞ্চলে
এরা অকারণে দুর্ণিবার প্রাণের ঢেউ
তবু ছুটে চলে যদিও দেখেনি সাগর কেউ-
………..বিদ্রোহী কবি
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি, বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী স্বাধীন বাংলার স্থপতি যার স্বপ্নের বাস্তবায়িত রূপ আজ আমাদের এই সুজলা সুফলা সোনার বাংলা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর জীবনের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব চিরতারুণ্যে মহিয়ান হয়ে আছেন আমাদের এই বিশ্ব নেতা। সারাটি জীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও কোনদিন আপোষ করেননি স্বাধীনতার প্রশ্নে, দেশ, মাটি, মা ও মানুষের প্রশ্নে।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মঙ্গলবার রাত ৮ ঘটিকায় টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়িতে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের উরসে খোকা নামক যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই খোকাই একদিন হয়ে উঠেছিলেন খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা, জাতির পিতা থেকে বিশ্ব নেতা। আর তারুণ্য বলতে আমরা যা বুঝি বাধা না মানা, শৃঙ্খলা ভঙের প্রত্যয়, সাহস, শৌর্য-বীর ও বীরত্ব প্রদর্শন অসম্ভবকে সম্ভব করা। এসব গুলোকে একত্র করে আমরা বলতে পারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আর এসবগুলো প্রত্যয়কে একসঙ্গে করে আমরা যদি কোনো কিছু দেখার ইচ্ছা পোষণ করি তাহলে দেখতে পাবো জাতির জনকের আপাদমস্তক।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবুল কালাম তারুণ্য সম্পর্কে বলেছেন তারুণ্য তাদের মধ্যেই বিদ্যমান থাকবে, যাদের ভিন্নভাবে চিন্তা করার ও উদ্ভাবনের সাহস থাকবে, অপরিচিত পথে চলার ও অসম্ভব জিনিস আবিষ্কারের সাহস থাকবে এবং সমস্যা জয় করে সফল হবে। আর এ সবগুলো উক্তির সংমিশ্রনে একটি শব্দ গঠিত হয় তা হল আমাদের বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীনচেতা শেখ মুজিবের মনে স্বাধীনতার ধারণা হয়েছিল ১৯৩৫ সালে মাদারীপুর হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালে, যখন তিনি নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর সমর্থকদের জনসভায় নিয়মিত যোগদান করেন এবং ধীরে ধীরে সুভাষ বসুর ভক্ত হয়ে উঠেন যেখানে ইংরেজদের বিরোধিতার ধারণাটি তার মনে জন্মেছিল।
গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্রাবস্থায় স্কুলের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হওয়া, মুসলিম সেবা সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন, ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পরে এর ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এবং শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জনসভা করতে গোপালগঞ্জ এসেছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু সেই জনসভা সফল করার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন মিশন স্কুল পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন মিশন স্কুলের ছাত্র হিসেবে এবং তখন থেকেই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নজরে আসেন। ১৯৩৯ সালে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে গোপালগঞ্জ নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের স্থানীয় কমিঠি গঠন করেন।
পরে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্থাব এবং ১৯৪১ সালে ফরিদপুর জিলা মুসলিম ছাত্রলীগ সমাবেশে যোগ দেন। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাবনার সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলীম লীগ সম্মেলন হয়। জিন্নাহ সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর থেকে এক বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে সেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু তার কৈশরের তারুণ্যে দিপ্তবান করে গেছেন আমাদের তারুণ্যেও পথের আলোকবর্তিকা হয়ে।
আমাদের তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, তারুণ্য সম্পর্কে বলেছিলেন:
“হে তারুণ্য
জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ অমৃতের স্পর্শ চায়,
অন্ধকারময় ত্রিকালের কারাগৃহ ছিন্ন করি
উদ্দাম গতিতে বেদনা বিদ্যুৎ শিখা জ্বালাময়
আত্নার আকাশে, ঊর্ধ্বমুখী আপনাকে দগ্ধ
করে প্রচণ্ড স্পর্শে’
কবির এ চরণগুলোর ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই আমাদের বঙ্গবন্ধু তারুণ্যে উদ্দীপ্ত এক জলন্ত অগ্নিপুরুষ। এ অগ্নিপুরুষের প্রায় ১২টি বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ যেমন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে যেমন কারাবরণ করেছেন তেমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানি আমলের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন ও সংগ্রাম করে কারাবরণ করেছিলেন।
তার প্রথম কারাজীবন শুরু হয়েছিল সেই গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র থাকাকালে। প্রথম কারা জীবন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার যে দিন প্রথম জেল হয় সেদিন আমার নাবালকত্ব ঘুঁচেছে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের ১৬৫ রোল নম্বরধারী এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রটি যখন ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১৫ টাকা জরিমানা করে। জরিমানা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মুচলেকা দিয়ে তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেননি। যদিও সেদিন অন্যান্যরা মুচলেকা দিয়ে ফিরে এসেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে। তার মনোবল ছিল অনেক শক্ত যে কারণে তিনি কখনও বন্ড স্বাক্ষর করে কোনোদিন মুক্তি লাভে ইচ্ছুক ছিলেন না। যদিও পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার প্রলোভনসহ কারাগারে বন্ড পাঠাতেন তাদের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে। আর এ মনোবলের মাধ্যমে প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর চির তারুণ্যের।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তরুণদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন:
‘হে তরুণ, তুমি জানো কী হস্তী মূর্খ কাহারে বলে? অপরিণাম শক্তি লইয়া ভাবিছ শক্তিহীন, জরারে সেবিয়া লভিয়েছ জরা হইতেছ আয়ুহীন, ভয়কে যারা ভুলিয়াছে সেই অভয় তরুণ দল, আসিবে যেদিন হাকিব সেদিন সময় হয়েছে চল।”
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম হওয়া সেই বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি দিনই ছিল ভয়কে ভুলে যাওয়ার, প্রতিটি দিনই ছিল হাক দেয়ার এবং প্রতিটি সময়ই ছিল পথ চলার। যে পথটি ছিল অনেক অমসৃন কিন্তু তিনি কোনদিনই মনে করেননি যে পথটি অমসৃন।
তিনি বলতেন, ‘আমি পালিয়ে যাওয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না’। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানের মিয়ামি কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন কারাবন্দিদের বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পর আমার লাশটি আমার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ো’।
তিনি সবসময় বলতেন দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগতো করতেই হবে এবং সেই ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে। আর সেই চরম ত্যাগটিই বঙ্গবন্ধু করেছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়িত ফল সুজলা ও সোনার বাংলাদেশকে ভালবেসেই। কিন্তু সেই মৃত্যেক্ষণেও তিনি তারুণ্যকে ভুলে যাননি।
তিনি অসীম সাহসের সাথেই ঘাতকদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোরা কারা? তোরা কী চাস?’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন সকল জায়গায়, সকল সময়ে, সর্বাবস্থায় একজন আপদমস্তক তারুণ্যের প্রতীক। বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করার মাধ্যমেই জাগ্রত হতে পারে আমাদের বর্তমান তরুণ সমাজের তারুণ্যের উদ্দীপনা এগিয়ে যেতে পারে আমাদের সমাজের জয়যাত্রা।
সবশেষে বলবো বঙ্গবন্ধু সর্বকালের বাধহীন তরুণ প্রজন্মের কন্ঠস্বর হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকুক।
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা কলেজ।