একটা ঐতিহাসিক দিন, জার্মানদের নিজস্ব দিন - এবং সেই সঙ্গে আরো অনেক কিছু, বিশেষ করে সাবেক পূর্ব জার্মানির মানুষদের কাছে। কিন্তু ফেডারাল জার্মান প্রজাতন্ত্র এবং সেই সঙ্গে ইউরোপের পক্ষে দিনটার তাৎপর্য কম নয়।
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর। দিনটা ছিল এক আশ্চর্য দিন। সন্ধ্যায় সেই আমলা-মার্কা ঘোষণা, ‘এখন থেকে সবার যাতায়াতের স্বাধীনতা থাকবে’।
সেখান থেকে শুরু করে সে’রাতে বার্লিন প্রাচীরের পতন অবধি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জার্মান তথা ইউরোপীয়দের জীবন পাল্টে যায়। কম্যুনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানি গণআন্দোলন আর পলায়নপর নাগরিকদের চাপে ভেঙে পড়ে।
বার্লিন প্রাচীরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জিডিআর’এর অন্ত ঘটে - যদিও পুনরেকত্রীকরণ ঘটে তার এক বছর পরে। জিডিআর’এর অস্তিত্বেরই আর কোনো কারণ থাকে না - এক ওয়ারশ’ জোটের সদস্যতা ছাড়া।
২৫ বছর আগে পূর্ব জার্মানির লাইপশিস শহরে শান্তিপূর্ণ মিছিলের মধ্য দিয়ে এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যে মিছিলে অংশ নিয়েছিলো ৭০,০০০ মানুষ। সেই মিছিলের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যান্য শহরেও। ভেঙে গিয়েছিল বার্লিন প্রাচীর। বিশ্বের ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল এক নতুন ইতিহাস।
তা সত্ত্বেও গর্বাচভ’এর নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং সেই সঙ্গে পূর্ব বার্লিনের ক্ষমতাসীন শাসকরা বলপ্রয়োগ করা থেকে বিরত থেকেছেন।
বেইজিং’এর স্বর্গীয় শান্তির চত্বরে যেমনটা হয়েছে, তেমন কোনো ‘‘চৈনিক সমাধান” পূর্ব জার্মানির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি। ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানি, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরি কিংবা ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার মতো ১৯৮৯ সালে পূর্ব জার্মানির স্বাধীনতা আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করা হয়নি। বার্লিন প্রাচীরের পতন পুবের জার্মানদের শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গ করে।
৯ নভেম্বর ছিল এক সুখের, আবেগের দিন। এ’দিনে সব বিস্মৃত, অবহেলিত অনুভূতি আবার ফুটে ওঠে: দু’তরফেই পুনর্মিলনের আকাঙ্খা; পুবের মানুষদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা৷ জার্মানরা, বিশেষ করে বার্লিনের মানুষজন যেন ঘোরে ছিলেন।
এমন এক আনন্দের অনুভূতি, যা আমাদের অনেককে কাঁদিয়ে ছেড়েছিল। সেই অনুভূতিই আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, ৪০ বছরের বিভাজনও দুই জার্মানির আত্মীয়তাবোধকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে উইলি ব্রান্ড’এর সেই চিরন্তন, অপরূপ কথাগুলি: ‘‘যা একসঙ্গে হবার কথা, তা’ই এখন একসঙ্গে হচ্ছে”।
জার্মান কথাটা হলো ‘ওয়াকসেন’, মানে গজিয়ে ওঠা, লতাপাতার মতো, প্রকৃতির মতো। সেই উদ্ভিন্ন জার্মান ঐক্যে কিন্তু জার্মানির প্রতিবেশীদের কোনো বিপদ ঘটেনি। ১৯৮৯’র শান্তিপূর্ণ বিপ্লব জার্মানিকে ইউরোপের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করে।
পুবের জার্মানদের বিদ্রোহ ছিল কম্যুনিস্ট একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে, যে ‘‘তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্র” সব কিছুকে নিয়মের জালে জড়িয়ে রাখে, বেঁধে রাখে। পুবের জার্মানরা বিদ্রোহ করেছিলেন এক উন্মুক্ত দেশের দাবিতে, যে দেশে মানুষজনকে আটকে রাখা হয় না। যে কারণে যাত্রার স্বাধীনতা ছিল তাদের একটি কেন্দ্রীয় দাবি। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমানোর দাবিটা অতো জোরালো ছিল না। যে কারণে ইতিহাসের একটি রসিকতা হলো এই যে, পুনরেকত্রিত জার্মানির রাজনৈতিক ডিএনএ’তে একটি ‘‘ শক্তিশালী কল্যাণরাষ্ট্রের” স্বপ্ন ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত।
৯ নভেম্বরের পর জার্মানি আরো বেশি প্রোটেস্টান্ট, আরো বেশি পূর্বমুখী, আদর্শবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আরো বেশি মধ্যমপন্থি এবং কম বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। বলতে কি, জার্মানি যেন আরো বাম-ঘেঁষা হয়ে উঠেছে। এই জার্মানির প্রতিনিধিত্ব এবং শাসনের দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক পূর্ব জার্মানির দুই নাগরিক: ইওয়াখিম গাউক এবং আঙ্গেলা ম্যার্কেল। জার্মানির অভ্যন্তরীণ ঐক্যও অনেক দূর এগিয়েছে, যদিও অনেকের কাছে তা এখনও দৃষ্টিগোচর নয়। সেই ঐক্যের সূচনা ঘটে ৯ নভেম্বর ১৯৮৯’র সুখস্মৃতিতে। তথ্যসূত্র- ডিডাব্লিউ