একাত্তরের মানবতাবিরোধী আপরাধ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহাল থাকার পর তা কার্যকরের আইনী বিধান নিয়ে এখন চলছে বিতর্ক। এই বিতর্কের ভেতরও সম্পন্ন হয়েছে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম।
এখন শুধু অপেক্ষার পালা। ধোঁয়ামোচ্ছা করে রাখা হয়েছে চার কারাগারের চারটি মঞ্চ। তবে শেষ পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই ফাঁসি কার্যকর হওয়ারই সম্ভাবনা বেশী।
আর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছিল, সেই শাহজাহানসহ থাকবে পাঁচ জল্লাদ। তাদের নিয়ে পর পর দু’রাতে দু’ফায় ডামি ফাঁসির মহড়া দেয়া হয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন কারা অধিদফতরের একজন শীর্ষ কর্মকতা। তবে ফাঁসির দিনক্ষন কখন এমন প্রশ্নের জবাবে ঐ কর্মকর্তা বলেন, যখন নির্দেশনা আসবে।
সর্বশেষ গত বছর ১২ ডিসেম্বর মানবতা বিরোধী অপরাধের দায় দন্ডিত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আর এটি ছিল সর্বশেষ ফাঁসির ঘটনা।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী মামলায় গত বছর ৯ মে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার আপিলের রায়ে গত ৩ নভেম্বর সোমবার ফাঁসির আদেশই বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত। রায় বহালের পর ঐ দিন রাতেই কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে তাকে স্থানান্তর করা হয় হাইসিকিউরিটি সেলে(একই ক্যাম্পাসে)। এরপর গত ৪ নভেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে আনা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
এরই মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত কামারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন তার পরিবারের দশ সদস্য। তারা হলেন কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার, ছেলে হাসান ইকবাল, ইকরাম হাসান, হাসান ঈমাম, মেয়ে আফিয়ান নূর, ভাই নাজিরুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল মাহাদী, বোন মোহসীনা বেগম ও ভাগ্নে আব্দুল আলিম। কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গত বুধবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে তারা কারাগারে প্রবেশ করেন। আধাঘন্টা সাক্ষাত শেষে বের হন বেলা ১১টা ৮ মিনিটে। এর আগে সর্বশেষ তার পরিবারের সঙ্গে দেখা হয় গত ১৪ সেপ্টম্বর কাশিমপুর-২ কারাগারে।
কামারুজ্জামানের পাঁচ ছেলে এক মেয়ের মধ্যে চার ছেলে ও মেয়ে গত বুধবার তার সঙ্গে কারাগারে দেখা করেন। তৃতীয় ছেলে হাসান জামান মালয়েশিয়া রয়েছেন।
সাক্ষাতের সময় পরিবারের নিয়ে যাওয়া মিষ্টি খেয়েছেন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের এই নেতা। মিষ্টিতে কিছু আছে কিনা- তা পরীক্ষা করার জন্য তা আগে কামারুজ্জামানের ভাই নাজিরুজ্জামানকে খাওয়ানো হয়।
এ সময় উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কামারুজ্জামানও মিষ্টি খাওয়ার সময় কাঁদেন। কারাগার সূত্র জানায়, কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা তার জন্য শুকনা মিষ্টি নিয়ে যান। সঙ্গে ছিল কোমল পানীয়।
পরিবারের সদস্যরা কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা হওয়ার কিছু সময় পরই তাকে মিষ্টি খাওয়াতে যান। এ সময় মিষ্টি খাওয়াতে বাধা দেন সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী। নাজিরুজ্জামানকে মিষ্টি খাওয়ানোর পরে কামারুজ্জামানকে মিষ্টি খাওয়ানের অনুমতি দেওয়া হয়।
এ সময় নীরব কনডেম সেলে এক বেধনাবিধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী বলেন, কামারুজ্জামান তার পরিবারের আনা শুকনো মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে খেয়েছেন।
সাক্ষাত শেষে কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল ঢাকা কেন্দ্রীয়কারাগার গেটে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার বাবার মৃত্যু হবে একটি আদর্শিক মৃত্যু। আমরা দেশবাসীর কাছে তার জন্য দেয়া চাই। সেইসময় তার বাবা সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন বলে তিনি দাবি করেন ।
রাষ্ট্রপতির কাছে প্রানভিক্ষা চাইবেন কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা পরের বিষয়। রিভিউর পরে বাবা ভাববেন। তবে এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত সিন্ধান্তের বিষয়।
এটা কী আপনাদের শেষ সাক্ষাত? এমন প্রশ্নের না সূচক জবাব দেন তিনি।
সাক্ষাত সম্পর্কে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী বলেন, নিয়মিত সাক্ষাতের অংশ হিসাবে কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে দেওয়া হয়েছে।
জেল কর্তৃপক্ষের এ প্রস্তুতির পাশাপাশি সারাদেশে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত ১২ জেলায় জারি করা হয়েছে হাই রেড এলার্ট। ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলে জামায়াত-শিবির সারাদেশে ব্যাপক নাশকতা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সাতদিন শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে আলোচিত হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
জেলাগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েনের প্রস্তুতি চলছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বসানো হয়েছে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা। প্রস্তুত থাকছে র্যাবের হেলিকপ্টার। যে কোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে আগাম কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সূত্র থেকে হাই রেড এলার্ট জারি করা জেলা ও এলাকার একটি তালিকা পাওয়া যায়। যেসব জেলায় হাই রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে তা হলো- সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, নাটোর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার ও পাবনা। এ ছাড়া বগুড়া জেলাকে স্পর্শকাতর বিবেচনায় নিয়ে রেড এলার্ট জারিসহ বিশেষভাবে সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। বিশেষ করে যশোরের অভয়নগর, মরিরামপুর, ঋষিপাড়া ও অভয়নগরের মালোপাড়া, সাতক্ষীরা সদর, রাজশাহীর বাঘা, দিনাজপুর সদর, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, রংপুরের পীরগঞ্জ, কাউনিয়া, গাইবান্ধার পলাশবাড়ি, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও সদরের পারেয়া ও নীমবাড়ি, পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া এবং কক্সবাজারের রামু এলাকায় হাই এলার্ট জারি করা হয়েছে। এসব এলাকায় যে কোন ধরনের অনাকাক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে আগাম নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। যারা নাশকতা চালানোর চেষ্টা করবে তাদের শক্তহাতে প্রতিহত করা হবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন।